পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৬৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা ७२> মহিম কহিলেন, “যেরকম গতিক দেখছি কিছু তো বলা যায় না। তুমি ভাবছ। ওটা একটা খাদ্যদ্রব্য, দিবি গিলে ফেলে তার পরে আবার ঘরে ফিরে আসবে। কিন্তু বড়শিটি ভিতরে আছে, সে তোমার বন্ধুর দশা দেখলেই বুঝতে পারবে। আরে, যাও কোথায়! আসল কথাটাই এখনাে হয় নি। ও দিকে ব্ৰহ্ম মেয়ের সঙ্গে বিনয়ের বিয়ে তো একেবারে পাকা হয়ে গেছে শুনতে পাচ্ছি। তার পর কিন্তু ওর সঙ্গে আমাদের কোনােরকম ব্যবহার চলবে না, সে আমি তোমাকে আগে থাকতেই বলে রাখছি।” গোরা কহিল, “সে তো চলবেই না ।” মহিম কহিলেন, “কিন্তু মা যদি গােলমাল করেন তা হলে সুবিধা হবে না। আমরা গৃহস্থ মানুষ, অমনিতেই মেয়েছেলের বিয়ে দিতে জিব বেরিয়ে পড়ে, তার পরে যদি ঘরের মধ্যে ব্ৰাহ্মসমাজ বসাও তা হলে আমাকে কিন্তু এখান থেকে বাস ওঠাতে হবে ।” গোরা কহিল, “না, সে কিছুতেই হবে না।” মেয়ে ঘরে নেবেন সোনা তার চেয়ে বেশি না নিয়ে ছাড়বেন না ; কারণ, তিনি জানেন মানুষ নিশ্বর পদার্থ সোনা তার চেয়ে বেশি দিন টেকে। ওষুধের চেয়ে অনুপানটার দিকেই তার ঝোক বেশি। বেহাই বললে তাকে খাটাে করা হয়, একেবারে বেহায়া। কিছু খরচ হবে বটে, কিন্তু লোকটার কাছে আমার অনেক শিক্ষা হল, ছেলের বিয়ের সময় কাজে লাগবে | ভারি লোভ হচ্ছিল আর-এক বার এ কালে জন্মগ্রহণ করে বাবাকে মাঝখানে বসিয়ে রেখে নিজের বিয়েটা একবার বিধিমত পাকিয়ে তুলি— পুরুষজন্ম যে গ্ৰহণ করেছি সেটাকে একেবারে ষোলো-আনা সার্থক করে নিই। একেই তো বলে পৌরুষ । মেয়ের বােপকে একেবারে ধরাশায়ী করে দেওয়া । কম কথা ! যাই বল, তোমার সঙ্গে যোগ দিয়ে যে নিশিদিন হিন্দুসমাজের জয়ধ্বনি করব কিছুতেই তাতে জোর পাচ্ছি নে ভাই, গলা উঠতে চায় না, একেবারে কাহিল করে ফেলেছে। আমার তিনকড়েটার বয়স এখন সবে চৌদ্দ মাস— গোড়ায় । কন্যা জন্ম দিয়ে শেষে তাঁর ভ্রম সংশোধন করতে সহধর্মিণী দীর্ঘকাল সময় নিয়েছেন । যা হােক, ওরই বিবাহের সময়টা পর্যন্ত, গোরা, তোমরা সকলে মিলে হিন্দুসমাজটাকে তাজা রেখে— তার পর দেশের লোক মুসলমান হােক, খৃস্টান হােক, আমি কোনাে কথা কব না।” বিনয়কে নিমন্ত্রণ করা চলবে না। তখন যে এই কথা নিয়ে আবার একটা কাণ্ড বাধিয়ে তুলবে সে হবে না | মাকে তুমি এখন থেকে সাবধান করে রেখে দিয়ে ।” ቆ፡ মাতার ঘরে আসিয়া গোরা দেখিল আনন্দময়ী মেজের উপর বসিয়া চশমা চোখে আঁটিয়া খাতা লাইয়া কিসের ফর্দ করিতেছেন। গোরাকে দেখিয়া তিনি চশমা খুলিয়া খাতা বন্ধ করিয়া কহিলেন, “বোস ।” গোরা বসিলে আনন্দময়ী কহিলেন, “তোর সঙ্গে আমার একটা পরামর্শ আছে। বিনয়ের বিয়ের খবর তো পেয়েছিস ?” গোরা চুপ করিয়া রহিল। আনন্দময়ী কহিলেন, “বিনয়ের কাকা রাগ করেছেন, তারা কেউ আসবেন না। আবার পরেশবাবুর বাড়িতেও এ বিয়ে হয় কি না সন্দেহ। বিনয়কেই সমস্ত বন্দােবস্ত করতে হবে। তাই আমি বলছিলুম, আমাদের বাড়ির উত্তর-ভাগটার একতলা তো ভাড়া দেওয়া হয়েছে- ওর দোতলার ভাড়াটেও উঠে গেছে, ঐ দােতলাতেই যদি বিনয়ের বিয়ের বন্দোবস্ত করা যায় তা হলে সুবিধা হয়।” গোরা জিজ্ঞাসা করিল, “কী সুবিধা হয় ?” আনন্দময়ী কহিলেন, “আমি না থাকলে ওর বিয়েতে দেখাশুনা করবে কে ? ও যে মহা বিপদে ‘ড়ে যাবে । ওখানে যদি বিয়ের ঠিক হয় তা হলে আমি এই বাড়ি থেকেই সমস্ত জোগাড়যন্ত্র করে দিতে পারি, কোনাে হাঙ্গম করতে হয় না।” গোরা কহিল, “সে হবে না। মা !”