পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৯৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা Ved করিতে পারে না। কিন্তু রূপককে হৃদয়ের ভক্তি দেওয়া যায় না। আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যাকে পূজা করা যায় না। বরঞ্চ মন্দিরে বসিয়া পূজার চেষ্টা না করিয়া ঘরে বসিয়া নিজের মনে অথবা কাহারও সঙ্গে তর্কোপলক্ষে যখন ভাবের স্রোতে মনকে ও বাক্যকে ভাসাইয়া দিত। তখন তাহার মনের মধ্যে একটা আনন্দ ও ভক্তিরসের সঞ্চার হইত। তবু গোরা ছাড়িল না— সে যথানিয়মে প্রতিদিন পূজায় বসিতে লাগিল, ইহাকে সে নিয়মম্বরূপেই গ্রহণ করিল। মনকে এই বলিয়া বুঝাইল, যেখানে ভাবের সূত্রে সকলের সঙ্গে মিলিবার শক্তি না থাকে। সেখানে নিয়মসূত্রই সর্বত্র মিলন রক্ষা করে। গোরা যখনই গ্রামে গেছে সেখানকার দেবমন্দিরে প্রবেশ করিয়া মনে মনে গভীরভাবে ধ্যান করিয়া বলিয়াছে, এইখানেই আমার বিশেষ স্থান- এক দিকে দেবতা ও এক দিকে ভক্ত- তাহারই মাঝখানে ব্ৰাহ্মণ সেতুস্বরূপ উভয়ের যোগ রক্ষা করিয়া আছে। ক্রমে গোরার মনে হইল, ব্ৰাহ্মণের পক্ষে ভক্তির প্রয়োজন নাই । ভক্তি জনসাধারণেরই বিশেষ সামগ্ৰী । এই ভক্ত ও ভক্তির বিষয়ের মাঝখানে যে সেতু তাহা জ্ঞানেরই সেতু । এই সেতু যেমন উভয়ের যোগ রক্ষা করে তেমনি উভয়ের সীমারক্ষাও করে । ভক্ত এবং দেবতার মাঝখানে যদি বিশুদ্ধ জ্ঞান ব্যবধানের মতো না থাকে। তবে সমস্তই বিকৃত হইয়া যায়। এইজনা ভক্তিবিহ্বলতা ব্ৰাহ্মণের সম্ভোগের সামগ্ৰী নহে, ব্ৰাহ্মণ জ্ঞানের চূড়ায় বসিয়া এই ভক্তির রসকে সর্বসাধারণের ভোগার্থে বিশুদ্ধ করিয়া রাখিবার জন্য তপস্যারত । সংসারে যেমন ব্ৰাহ্মণের জন্য আরামের ভোগ নাই, দেবাৰ্চিনাতেও তেমনি ব্ৰাহ্মণের জন্য ভক্তির ভোগ নাই । ইহাই ব্ৰাহ্মণের গৌরব | সংসারে ব্ৰাহ্মণের জন্য নিয়মসংযম এবং ধর্মসাধনায় ব্ৰাহ্মণের জন্য জ্ঞান | হৃদয় গোরাকে হার মানাইয়াছিল, হৃদয়ের প্রতি সেই অপরাধে গোরা নির্বাসনদণ্ড বিধান করিল। কিন্তু নির্বাসনে তাহাকে লইয়া যাইবে কে ? সে সৈন্য আছে কোথায় ? AS গঙ্গার ধারে বাগানে প্ৰায়শ্চিত্তসভার আয়োজন হইতে লাগিল । অবিনাশের মনে একটা আক্ষেপ বােধ হইতেছিল যে, কলিকাতার বাহিরে অনুষ্ঠানটা ঘটিতেছে, ইহাতে লোকের চক্ষু তেমন করিয়া আকৃষ্ট হইবে না। অবিনাশ জনিত, গোরার নিজের জন্য প্রায়শ্চিত্তের কোনো প্রয়োজন নাই, প্রয়োজন দেশের লোকের জন্য। মরাল এফেকটু ! এইজন্য ভিড়ের মধ্যেই এ কাজ দরকার । কিন্তু গোরা রাজি হইল না । সে যেরূপ বৃহৎ হােম করিয়া, বেদমন্ত্র পড়িয়া এ কাজ করিতে চায়, কলিকাতা শহরের মধ্যে তেমনটা মানায় না। ইহার জন্য তপোবনের প্রয়োজন । স্বাধ্যয়মুখরিত হােমাগ্নিদীপ্ত নিভৃত গঙ্গাতীরে, যে প্রাচীন ভারতবর্ষ জগতের গুরু তাহাকেই গোরা আবাহন করিবে এবং স্নান করিয়া পবিত্ৰ হইয়া তাহার নিকট হইতে সে নবজীবনের দীক্ষা গ্ৰহণ করিবে । গোরা মরাল এফেকটের জন্য ব্যস্ত নহে। অবিনাশ তখন অনন্যগতি হইয়া খবরের কাগজের আশ্রয় গ্ৰহণ করিল । সে গোরাকে না। জানাইয়াই এই প্ৰায়শ্চিত্তের সংবাদ সমস্ত খবরের কাগজে রটনা করিয়া দিল । শুধু তাই নহে, সম্পাদকীয় কোঠায় সে বড়ো বড়ো প্ৰবন্ধ লিখিয়া দিল— তাহাতে সে এই কথাই বিশেষ করিয়া জানাইল যে, গোরার মতো তেজস্বী পবিত্ৰ ব্ৰাহ্মণকে কোনো দোষ স্পর্শ করিতে পারে না, তথাপি গোরা বর্তমান পতিত ভারতবর্ষের সমস্ত পাতক নিজের স্কন্ধে লইয়া সমস্ত দেশের হইয়া প্ৰায়শ্চিত্ত করিতেছে। সে লিখিল— আমাদের দেশ যেমন নিজের দুস্কৃতির ফলে বিদেশীর বন্দীশালায় আজ দুঃখ পাইতেছে, গোরাও তেমনি নিজের জীবনে সেই বন্দীশালায় বাসদুঃখ স্বীকার করিয়া লইয়াছে। এইরূপে দেশের দুঃখ সে যেমন নিজে বহন করিয়াছে এমনি করিয়া দেশের অনাচারের প্রায়শ্চিত্তও সে নিজে অনুষ্ঠান করিতে প্রস্তুত হইয়াছে, অতএব ভাই বাঙালি, ভাই ভারতের পঞ্চবিংশতিকোটি দুঃখী সন্তান, তোমরা- ইত্যাদি ইত্যাদি । - গােরা এই সমস্ত লেখা পড়িয়া বিরক্তিতে অস্থির হইয়া পড়িল। কিন্তু অবিনাশকে পারিবার জো |9||8 रे