পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭০৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা \ტ\უ\9) AV সুচরিতা যখন চোখের জল লুকাইবার জন্য তেরঙ্গের পরে ঝুঁকিয়া পড়িয়া কাপড় সাজাইতে ব্যস্ত ছিল এমন সময় খবর আসিল, গৌরমোহনবাবু আসিয়াছেন। সুচরিতা তাড়াতাড়ি চোখ মুছিয়া তাহার কাজ ফেলিয়া উঠিয়া পড়িল । এবং তখনই গোরা ঘরের মধ্যে আসিয়া প্ৰবেশ করিল। গোরার কপালে তিলক তখনো রহিয়া গেছে, সে সম্বন্ধে তাহার খেয়ালই ছিল না । গায়েও তাহার তেমনি পট্টবস্ত্র পরা। এমন বেশে সচরাচর কেহ কাহারও বাড়িতে দেখা করিতে আসে না । সেই প্রথম গোরার সঙ্গে যেদিন দেখা হইয়াছিল সেই দিনের কথা সুচরিতার মনে পড়িয়া গেল। সুচরিতা জানিত, সেদিন গোরা বিশেষ করিয়া যুদ্ধের বেশে আসিয়াছিল— আজও কি এই যুদ্ধের সাজ ! গোরা আসিয়াই একেবারে মাটিতে মাথা ঠেকাইয়া পরেশকে প্ৰণাম করিল এবং তাহার পায়ের ধূলা লাইল। পরেশ ব্যস্ত হইয়া তাহাকে তুলিয়া ধরিয়া কহিলেন, “এসো, এসো বাবা, বােসে।” গোরা বলিয়া উঠিল, “পরেশবাবু, আমার কোনো বন্ধন নেই।” পরেশবাবু আশ্চর্য হইয়া কহিলেন, “কিসের বন্ধন ?” গোরা কহিল, “আমি হিন্দু নই।” পরেশবাবু কহিলেন, “হিন্দু নও।” গোরা কহিল, “না, আমি হিন্দু নই। আজ খবর পেয়েছি। আমি মিউটিনির সময়কার কুড়োনো ছেলে, আমার বাপ আইরিশম্যান । ভারতবর্ষের উত্তর থেকে দক্ষিণ পর্যন্ত সমস্ত দেবমন্দিরের দ্বার আজ আমার কাছে রুদ্ধ হয়ে গেছে, আজ সমস্ত দেশের মধ্যে কোনাে পঙক্তিতে কোনাে জায়গায় আমার আহারের আসন নেই ।” পরেশ ও সুচরিতা স্তম্ভিত হইয়া বসিয়া রহিলেন। পরেশ তাঁহাকে কী বলিবেন ভাবিয়া পাইলেন ୩ | গোরা কহিল, “আমি আজ মুক্ত পারেশবাবু! আমি যে পতিত হব, ব্রাত্য হব, সে ভয় আর আমার নেই- আমাকে আর পদে পদে মাটির দিকে চেয়ে শুচিত বঁচিয়ে চলতে হবে না ।” সুচরিতা গোরার প্রদীপ্ত মুখের দিকে একদৃষ্টিতে চাহিয়া রহিল। গোরা কহিল, “পরেশবাবু, এতদিন আমি ভারতবর্ষকে পাবার জন্যে সমস্ত প্ৰাণ দিয়ে সাধনা করেছি- একটা-না-একটা জায়গায় বেধেছে- সেই-সব বাধার সঙ্গে আমার শ্রদ্ধার মিল করবার জন্য আমি সমস্ত জীবন দিন-রাত কেবলই চেষ্টা করে এসেছি— এই শ্রদ্ধার ভিত্তিকেই খুব পাকা করে। তোেলবার চেষ্টায় আমি আর-কোনো কাজই করতে পারি নি— সেই আমার একটিমাত্র সাধনা ছিল | এসেছি— আমি একটি নিষ্কণ্টক নির্বিকার ভাবের ভারতবর্ষ গড়ে তুলে সেই অভেদ্য দুর্গের মধ্যে আমার ভক্তিকে সম্পূর্ণ নিরাপদে রক্ষা করবার জন্যে এতদিন আমার চারিদিকের সঙ্গে কী লড়াই না করেছি! আজি এক মুহুর্তেই আমার সেই ভাবের দুর্গ স্বপ্নের মতো উড়ে গেছে। আমি একেবারে ছাড়া পেয়ে হঠাৎ একটা বৃহৎ সত্যের মধ্যে এসে পড়েছি। সমস্ত ভারতবর্ষের ভালোমন্দ সুখদুঃখ জ্ঞান-অজ্ঞান একেবারেই আমার বুকের কাছে এসে পৌচেছে— ‘আজ আমি সত্যকার সেবার অধিকারী হয়েছি- সত্যকার কর্মক্ষেত্র আমার সামনে এসে পড়েছে- সে আমার মনের ভিতরকার ক্ষেত্র নয়- সে এই বাইরের পঞ্চবিংশতি কোটি লোকের যথার্থ কল্যাণক্ষেত্ৰ ।” গোরার এই নবলব্ধ অনুভূতির প্রবল উৎসাহের বেগ পরেশকেও যেন আন্দােলিত করিতে লাগিল, তিনি আর বসিয়া থাকিতে পারিলেন না— চৌকি ছাড়িয়া উঠিয়া দাড়াইলেন। গোরা কহিল, “আমার কথা কি আপনি ঠিক বুঝতে পারছেন ? আমি যা দিনরাত্রি হতে চাচ্ছিলুম