পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭২৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বিচিত্ৰ প্ৰবন্ধ \უხr(? যাহারা আলোক-উপাসক তাহারা এই সম্প্রদায়ের প্রতি অনুরাগ প্রকাশ করে নাই। তাহারা হাদিগকে যে-সকল নামে অভিহিত করিয়াছে আমরা তাহার অনুমোদন করি না। বররুচি ইহাদিগকে অবসিক বলিয়াছেন, আমাদের মতে ইহা রুচিগৰ্হিত | আমরা ইহাদিগকে যাহা মনে করি তাহা মনেই রাখিয়া দিই। কিন্তু প্রাচীনেরা মুখ সামলাইয়া কথা কহিতেন না। তাহার পরিচয় একটি সংস্কৃত শ্লোকে গাই । ইহাতে বলা হইতেছে- সিংহনখরের দ্বারা উৎপাটিত একটি গজমুক্তা বনের মধ্যে পড়িয়ছিল, কোনাে ভীলরমণী দূর হইতে দেখিয়া ছুটিয়া গিয়া তাহা তুলিয়া লইল, যখন টিপিয়া দেখিল তাহা পাকা কুল নহে, তাহা মুক্তমত্র, তখন দূরে ছুড়িয়া ফেলিল। স্পষ্টই বুঝা যাইতেছে, প্রয়ােজনীয়তা-বিবেচনায় যাহারা সকল জিনিসের মূল্যনির্ধারণ করেন, শুদ্ধমাত্র সৌন্দর্য ও উজ্জ্বলতার দিতেছেন । আমাদের বিবেচনায় কবি ইহাদের সম্বন্ধে নীরব থাকিলেই ভালো করিতেন- কারণ, হৈারা ক্ষমতাশালী লোক, বিশেষত, বিচারের ভার প্রায় ইহাদেরই হাতে । ইহারা গুরুমহাশয়ের কাজ না করুন, এই আমার প্রার্থনা | সাহিত্যের যথাৰ্থ বাজে রচনাগুলি কোনাে বিশেষ কথা বলিবার স্পর্ধ রাখে না। সংস্কৃত সাহিতে্যু মেঘদূত তাহার উজ্জল দৃষ্টান্ত। তাহ ধর্মের কথা নহে, কর্মের কথা নহে, পুরাণ নহে, ইতিহাস নহে। যে অবস্থায় মানুষের চেতন-অচেতনের বিচার লোপ পাইয়া যায় ইহা সেই অবস্থার প্রলাপ | ইহাকে যদি কেহ বদরীফল মনে করিয়া পেট ভরাইবার আশ্বাসে তুলিয়া লন তবে তখনি ফেলিয়া দিবেন। ইহাতে প্রয়োজনের কথা কিছুই নাই । ইহা নিটােল মুক্তা, এবং ইহাতে বিরহীর বিদীর্ণ হৃদয়ের রক্তচিহ্ন কিছু লাগিয়াছে, কিন্তু সেটুকু মুছিয়া ফেলিলেও ইহার মূল কমিবে না। ইহার কোনো উদ্দেশ্য নাই বলিয়াই এ কাব্যখনি এমন স্বচ্ছ, এমন উজ্জ্বল। ইহা একটি মায়াতরী ; কল্পনার হাওয়ায় ইহার সজল-মেঘ-নির্মিত পাল ফুলিয়া উঠিয়াছে এবং একটি বিরহীর হৃদয়ের কামনা বহন করিয়া ইহা অবারিতবেগে একটি অপরূপ নিরুদ্দেশের অভিমুখে ছুটিয়া চলিয়াছে— আর-কোনো বোঝা ইহাতে নাই | টেনিসন যে idle tears, যে অকারণ অশ্রুবিন্দুর কথা বলিয়াছেন, মেঘদূত সেই বাজে চােখের জলের কাব্য । এই কথা শুনিয়া অনেকে আমার সঙ্গে তর্ক করিতে উদ্যত হইবেন । অনেকে বলবেন, যক্ষ যখন প্ৰভুশাপে তাহার প্রেয়সীর নিকট হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়াছে তখন মেঘদূতের অশ্রুধারাকে অকারণ বলিতেছেন কেন ? আমি তর্ক করিতে চাই না, এ-সকল কথার আমি কোনো উত্তর দিব না । আমি জোর করিয়া বলিতে পারি, ঐ-যে যক্ষের নির্বাসন প্রভৃতি ব্যাপার ও-সমস্তই কালিদাসের বানানো, কাব্যরচনার ও একটা উপলক্ষমাত্ৰ ৷ ঐ ভারা বাধিয়া তিনি এই ইমারত গডিয়াছেন ; এখন আমরা ঐ ভরাটা ফেলিয়া দিব। আসল কথা, ‘রম্যাণি বীক্ষ্য মধুরাংশ্চ নিশম্য শব্দান মন অকারণ বিরহে বিকল হইয়া উঠে, কালিদাস অন্যত্র তাহা স্বীকার করিয়াছেন। আষাঢ়ের প্রথম দিনে অকস্মাৎ ঘনমেঘের ঘটা দেখিলে আমাদের মনে এক সৃষ্টিছাড়া বিরহ জাগিয়া উঠে, মেঘদূত সেই অকারণ বিরহের অমূলক প্ৰলাপ | তা যদি না হইত, তবে বিরহী মেঘকে ছাড়িয়া বিদ্যুৎকে দূত পঠাইত। তবে পূর্বমেঘ এত রহিয়া বসিয়া, এত ঘুরিয়া ফিরিয়া, এত যুথীবন প্রফুল্ল করিয়া, এত জনপদবধূর উৎক্ষিপ্ত দৃষ্টির কটাক্ষপাত লুটিয়া লইয়া চলিত না । কাব্য পড়বার সময়ও যদি হিসাবের খাতা খুলিয়া রাখিতেই হয়, যদি কী লাভ করিলাম হাতে হাতে তাহার নিকাশ চুকাইয়া লইতেই হয়, তবে স্বীকার করিব মেঘদূত হইতে আমরা একটি তথ্য লাভ করিয়া পুলকিত হইয়াছি। সেটি এই যে, তখনো মানুষ ছিল এবং তখনে আষাঢ়ের প্রথম দিন যথানিয়মে আসিত । কিন্তু অসহিষ্ণু বররুচি যাহাদের প্রতি অশিষ্ট বিশেষণ প্রয়োগ করিয়াছেন তাহারা কি এরূপ লাভকে লাভ বলিয়াই গণ্য করবেন ? ইহাতে কি জ্ঞানের বিস্তার, দেশের উন্নতি, চরিত্রের সংশোধন ঘটিবে ?