পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৩৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বিচিত্র প্রবন্ধ Vibo চিহ্নিত। আমার উপর যখন অস্ত্ৰ আসিয়া পড়িয়াছে তখন আমার চারিদিকের পৃথিবী সরিয়া দাঁড়ায় নাই ; শরা আমাকে ভেদ করিয়া তাহাকে বিদ্ধ করিয়াছে। এমনি করিয়া বারংবার আমার সুখদুঃখের ছাপ লাগিয়া পৃথিবীটা আমারই বলিয়া চিহ্নিত হইয়া গেছে। মেঘে আমার কোনো চিহ্ন নাই। সে পথিক, আসে যায়, থাকে না । আমার জরা তাহাকে স্পর্শ করিবার অবকাশ পায় না। আমার আশনৈরাশ্য হইতে সে বহুদূরে। এইজন্য, কালিদাস উজ্জয়িনীর প্রাসাদশিখর হইতে যে আষাঢ়ের মেঘ দেখিয়াছিলেন আমরাও সেই মেঘ দেখিয়াছি, ইতিমধ্যে পরিবর্তমান মানুষের ইতিহাস তাঁহাকে স্পর্শ করে নাই। কিন্তু সে অবন্তী, সে বিদিশা কোথায় ? মেঘদূতের মেঘ প্রতিবৎসর চিরনূতন চিরপুরাতন হইয়া দেখা দেয়— বিক্ৰমাদিত্যের যে উজ্জয়িনী মেঘের চেয়ে দৃঢ় ছিল, বিনষ্ট স্বপ্নের মতো তাহাকে আর ইচ্ছা করিলে গড়িবার জো নাই | মেঘ দেখিলে "সুখিনোেহপ্যন্যথাবৃত্তিচেতঃ', সুখীলোকেরও আনমনা ভাব হয়, এইজন্যই। মেঘ মনুষ্যলোকের কোনো ধার ধারে না বলিয়া, মানুষকে অভ্যস্ত গণ্ডির বাহিরে লইয়া যায়। মেঘের সঙ্গে আমাদের প্রতিদিনের চিন্তা-চেষ্টা-কাজকর্মের কোনো সম্বন্ধ নাই বলিয়া সে আমাদের মনকে ছুটি দেয়। মন তখন বাধন মানিতে চাহে না, প্ৰভুশাপে নির্বাসিত যক্ষের বিরহ তখন উদ্দাম হইয়া উঠে । প্রভূতৃত্যের সম্বন্ধ, সংসারের সম্বন্ধ ; মেঘ সংসারের এই সকল প্রয়োজনীয় সম্বন্ধগুলাকে ভুলইয়া দেয়, তখনই হৃদয় বাধ ভাঙিয়া আপনার পথ বাহির করিতে চেষ্টা করে । মেঘ আপনার নিত্যনূতন চিত্রবিন্যাসে, অন্ধকারে, গর্জনে, বর্ষণ, চেনা পৃথিবীর উপর একটা প্রকাণ্ড অচেনার আভাস নিক্ষেপ করে ; একটা বহুদূরকালের এবং বহুদূরদেশের নিবিড় ছায়া ঘনাইয়া তোলে ; তখন পরিচিত পৃথিবীর হিসাবে যাহা অসম্ভব ছিল তাঁহা সম্ভবপর বলিয়া বোধ হয়। কর্মপাশাবদ্ধ প্ৰিয়তম যে আসিতে পারে না, পথিকবধূ তখন এ কথা আর মানিতে চাহে না । সংসারের কঠিন নিয়ম সে জানে, কিন্তু জ্ঞানে জানে মাত্র ; সে নিয়ম যে এখনো বলবান আছে, নিবিড় বর্ষার দিনে এ কথা তাহার হৃদয়ে প্রতীতি হয় না। সেই কথাই ভাবিতেছিলাম— ভোগের দ্বারা এই বিপুল পৃথিবী, এই চিরকালের পৃথিবী, আমার কাছে খর্ব হইয়া গেছে। আমি তাহাকে যতটুকু পাইয়াছি তাহাকে ততটুকু বলিয়াই জানি, আমার ভোগের বাহিরে তাহার অস্তিত্ব আমি গণ্যই করি না । জীবন শক্ত হইয়া বাধিয়া গেছে, সঙ্গে সঙ্গে সে নিজের আবশ্যক পৃথিবীটুকুকে টানিয়া আটিয়া লইয়াছে। নিজের মধ্যে এবং নিজের পৃথিবীর মধ্যে এখন আর কোনো রহস্য দেখিতে পাই না বলিয়াই শান্ত হইয়া আছি ; নিজেকে সম্পূর্ণ জানি মনে করি এবং নিজের পৃথিবীটুকুকেও সম্পূৰ্ণ জানিয়াছি বলিয়া স্থির করিয়াছি। এমন সময় পূর্বদিগন্ত স্নিগ্ধ অন্ধকারে আচ্ছন্ন করিয়া কোথা হইতে সেই শত-শতাব্দী পূর্বেকার কালিদাসের মেঘ আসিয়া উপস্থিত হয়। সে আমার নহে, আমার পৃথিবীটুকুর নহে; সে আমাকে কোন অলকাপুরীতে, কোন চিরযৌবনের রাজ্যে, চিরবিচ্ছেদের বেদনায়, চিরমিলনের আশ্বাসে, চিরসৌন্দর্যের কৈলাসপুরীর পথচিহ্নহীন তীর্থভিমুখে আকর্ষণ করিতে থাকে। তখন পৃথিবীর যেটুকু জানি সেটুকু তুচ্ছ হইয়া যায়, যাহা জানিতে পারি নাই তাঁহাই বড়ো হইয়া উঠে, যাহা পাইলাম না। তাহাকেই লব্ধ জিনিসের চেয়ে বেশি সত্য মনে হইতে থাকে । জানিতে পারি, আমার জীবনে আমার শক্তিতে অতি অল্পই অধিকার করিতে পারিয়াছি, যাহা বৃহৎ তাহাকে স্পর্শও করি নাই। আমার নিত্যকর্মক্ষেত্ৰকে, নিত্যপরিচিত সংসারকে, আচ্ছন্ন করিয়া দিয়া সজলমেঘমেদুর পরিপূর্ণ নববর্ষা আমাকে অজ্ঞাত ভাবলোকের মধ্যে সমস্ত বিধিবিধানের বাহিরে একেবারে একাকী দাড় করাইয়া দেয় ; পৃথিবীর এই কয়টা বৎসর কড়িয়া লইয়া আমাকে একটি প্রকাণ্ড পরমায়ুর বিশালত্বের মাঝখানে স্থাপন করে ; আমাকে রামগিরি-আশ্রমের জনশূন্য শৈলশৃঙ্গের শিলাতলে সঙ্গীহীন ছাড়িয়া দেয়। সেই নির্জন শিখর এবং আমার কোনো-এক চিরনিকেতন, অন্তরাত্মার চিরগম্যস্থান, অলকাপুরীর মাঝখানে একটি সুবৃহৎ সুন্দর পৃথিবী পড়িয়া আছে মনে পড়ে ; নদীকলধ্বনিত সানুমৎপর্বতবন্ধুর