পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৩৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Ved O রবীন্দ্র-রচনাবলী জম্বুকুঞ্জচ্ছায়ান্ধকার নববারিসিঞ্চিতষুখীসুগন্ধি একটি বিপুল পৃথিবী। হৃদয় সেই পৃথিবীর বনে বনে গ্রামে গ্রামে শৃঙ্গে শৃঙ্গে নদীর কূলে কুলে ফিরিতে ফিরিতে, অপরিচিত সুন্দরের পরিচয় লইতে লইতে দীর্ঘ বিরহের শেষ মোক্ষস্থানে যাইবার জন্য মানসোৎক হংসের ন্যায় উৎসুক হইয়া উঠে। মেঘদূত ছাড়া নববর্ষার কাব্য কোনো সাহিত্যে কোথাও নাই। ইহাতে বর্ষার সমস্ত অন্তৰ্বেদনা নিত্যকালের ভাষায় লিখিত হইয়া গেছে। প্রকৃতির সাংবাৎসরিক মেঘোৎসবের অনির্বচনীয় কবিত্বগাথা মানবের ভাষায় বাধা পড়িয়াছে। পূর্বমেঘে বৃহৎ পৃথিবী আমাদের কল্পনার কাছে উদঘাটিত হইয়াছে। আমরা সম্পন্ন গৃহস্থটি হইয়া আরামে সন্তোষে অর্ধনিমীলিতলোচনে যে গৃহটুকুর মধ্যে বাস করিতেছিলাম, কালিদাসের মেঘ “আষাঢ়স্য প্রথমদিবসে’ হঠাৎ আসিয়া আমাদিগকে সেখান হইতে ঘরছাড়া করিয়া দিল । আমাদের গোয়ালঘর-গোলাবাড়ির বহুদূরে যে আবর্তচঞ্চলা নর্মদা ভুকুটি রচনা করিয়া চলিয়াছে, যে চিত্ৰকূটের পাদকুঞ্জে প্রফুল্ল নবনীপে বিকশিত, উদয়নকথাকোবিদ গ্রামবৃদ্ধিদের দ্বারের নিকটে যে চৈত্যাবট শুককাকলীতে মুখর, তাহাই আমাদের পরিচিত ক্ষুদ্র সংসারকে নিরস্ত করিয়া বিচিত্র সৌন্দর্যের চিরসত্যে উদভাসিত হইয়া দেখা দিয়াছে। বিরহীর ব্যগ্ৰতাতেও কবি পথসংক্ষেপ করেন নাই। আষাঢ়ের নীলাভ মেঘাচ্ছায়াবৃত নাগ-নদী নগর-জনপদের উপর দিয়া রহিয়া রহিয়া ভাবাবিষ্ট অলসগমনে যাত্রা করিয়াছেন। যে র্তাহার মুগ্ধ নয়নকে অভ্যর্থনা করিয়া ডাকিয়াছে তিনি তাহাকে আর “ন’ বলিতে পারেন নাই। পাঠকের চিত্তকে কবি বিরহের বেগে বাহির করিয়াছেন, আবার পথের সৌন্দর্যে মন্থর করিয়া তুলিয়াছেন। যে চরম স্থানে মন ধাবিত হইতেছে তাহার সুদীর্ঘ পথটিও মনোহর, সে পথকে উপেক্ষা করা যায় না। বর্ষায় অভ্যস্ত পরিচিত সংসার হইতে বিক্ষিপ্ত হইয়া মন বাহিরের দিকে যাইতে চায়, পূর্বমেঘে কবি সঙ্গী করিয়া অপরিচিত পৃথিবীর মাঝখােন দিয়া লইয়া চলিয়াছেন। সে পৃথিবী “অনাস্ত্ৰাতং পুষ্পম, তাহা আমাদের প্রাত্যহিক ভোগের দ্বারা কিছুমাত্র মলিন হয় নাই, সে পৃথিবীতে আমাদের পরিচয়ের প্রাচীর দ্বারা কল্পনা কোনোখানে বাধা পায় না । যেমন ঐ মেঘ তেমনি সেই পৃথিবী | আমার এই সুখদুঃখ-ক্লান্তি-অবসাদের জীবন তাহাকে কোথাও স্পর্শ করে নাই । প্রৌঢ়বয়সের নিশ্চয়তা বেড়া দিয়া, ঘের দিয়া, তাহাকে নিজের বাস্তুবাগানের অন্তরভুক্ত করিয়া লয় নাই । অজ্ঞাত নিখিলের সহিত নবীন পরিচয়, এই হইল পূর্বমেঘ। নবমেঘের আর-একটি কাজ আছে। সে আমাদের চারিদিকে একটি পরমনিভৃত পরিবেষ্টন রচনা করিয়া ‘জননােস্তরসৌহৃদানি মনে করাইয়া দেয়, অপরূপ সৌন্দর্যলোকের মধ্যে কোনো-একটি চিরজ্ঞাত চিরপ্রিয়ের জন্য মনকে উতলা করিয়া (No6 | পূর্বমেঘে বহুবিচিত্রের সহিত সৌন্দর্যের পরিচয় এবং উত্তরমেঘে সেই একের সহিত আনন্দের সম্মিলন। পৃথিবীতে বহুর মধ্য দিয়া সেই সুখের যাত্রা, এবং স্বৰ্গলোকে একের মধ্যে সেই অভিসারের পরিণাম । নববর্ষার দিনে এই বিষয়কর্মের ক্ষুদ্র সংসারকে কে না বলিবে নির্বােসন । প্রভুর অভিশাপেই এখানে গান ; এবং যাত্রার অবসানে চিরমিলনের জন্য আশ্বাস দেয়, তাহাই উত্তরমেঘের সংবাদ । সকল কবির কাব্যেরই গৃঢ় অভ্যন্তরে এই পূর্বমেঘ ও উত্তরমেঘ আছে। সকল বড়ো কাব্যই আমাদিগকে বৃহতের মধ্যে আহবান করিয়া আনে ও নিভৃতের দিকে নির্দেশ করে। প্রথমে বন্ধন ছেদন করিয়া বাহির করে, পরে একটি ভূমীর সহিত বঁধিয়া দেয়। প্রভাতে পথে লইয়া আসে, সন্ধ্যায় ঘরে লইয়া যায়। একবার তানের মধ্যে আকাশ-পাতল ঘুরাইয়া সমের মধ্যে পূর্ণ আনন্দে দাড় করাইয়া (if যে কবির তান আছে, কিন্তু কোথাও সম নাই- যাহার মধ্যে কেবল উদ্যম আছে, আশ্বাস নাই