পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৪৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বিচিত্ৰ প্ৰবন্ধ ԳO(; এবড়ো-খেবড়ো, ইতস্তত কতকগুলাইট খসিয়া পড়িয়ছে, অনেকগুলি ঝামা ছড়ানো, স্থানে স্থানে মাটি কাটা- এই অনুর্বরতা-বন্ধুরতার মধ্যে পাজাগুলো কেমন হতভাগ্যের মতো দাড়াইয়া থাকে। গাছের শ্রেণীর মধ্য হইতে শিবের দ্বাদশ মন্দির দেখা যাইতেছে ; সমুখে ঘাট, নহবতখানা হইতে নহবত বাজিতেছে। তাহার ঠিক পাশেই খেয়াঘাট । কঁচা ঘাট, ধাপে ধাপে তালগাছের গুড়ি দিয়া বঁধানে । আর, দক্ষিণে কুমারদের বাড়ি, চাল হইতে কুমড়া বুলিতেছে। একটি প্রৌঢ়া কুটিরের দেয়ালে গোবর দিতেছে ; প্রাঙ্গণ পরিষ্কার, তকতক করিতেছে ; কেবল এক প্রান্তে মাচার উপরে লাউ লতাইয়া উঠিয়াছে, আর-এক দিকে তুলসীতলা । সূর্যাস্তের নিস্তরঙ্গ গঙ্গায় নীেকা ভাসাইয়া দিয়া গঙ্গার পশ্চিম-পারের শোভা যে দেখে নাই সে বাংলার সৌন্দর্য দেখে নাই বলিলেও হয়। এই পবিত্র শান্তিপূর্ণ অনুপম সৌন্দর্যচ্ছবির বর্ণনা সম্ভবে না। এই স্বর্ণচ্ছায় স্নান সন্ধ্যালোকে দীর্ঘ নারিকেলের গাছগুলি, মন্দিরের চূড়া, আকাশের পট আঁকা নিস্তব্ধ গাছের মাথাগুলি, স্থির জলের উপরে লবণ্যের মতো সন্ধার আভা- সুমধুর বিরাম, নির্বাপিত কলরব, অগাধ শান্তি— সে-সমস্ত মিলিয়া নন্দনের একখানি মরীচিকার মতো, ছায়াপথের পরপরবতী সুদূর শান্তিনিকেতনের একখানি ছবির মতো, পশ্চিমদিগন্তের ধারটুকুতে আঁকা দেখা যায়। ক্রমে সন্ধ্যার আলো মিলাইয়া যায়, বনের মধ্যে এ দিকে ও দিকে এক-একটি করিয়া প্ৰদীপ জ্বলিয়া উঠে, সহসা দক্ষিণের দিক হইতে একটা বাতাস উঠিতে থাকে, পাতা ঝরঝর করিয়া কঁপিয়া উঠে, অন্ধকারে বেগবতী নদী বহিয়া যায়, কুলের উপরে অবিশ্রাম তরঙ্গ-আঘাতে ছলছল করিয়া শব্দ হইতে থাকেআর-কিছু ভালো দেখা যায় না, শোনা যায় না, কেবল ঝিঝি পোকার শব্দ উঠে, আর জোনাকিগুলি অন্ধকারে জ্বলিতে নিভিতে থাকে। আরো রাত্রি হয়। ক্রমে কৃষ্ণপক্ষের সপ্তমীর চাঁদ ঘোর অন্ধকার অশথ গাছের মাথার উপর দিয়া ধীরে ধীরে আকাশে উঠিতে থাকে । নিম্নে বনের শ্রেণীবদ্ধ অন্ধকার, আর উপরে স্নান চন্দ্রের আভা । খানিকটা আলো অন্ধকার-ঢালা গঙ্গার মাঝখানে একটা জায়গায় পড়িয়া তরঙ্গে তরঙ্গে ভাঙিয়া ভাঙিয়া যায়। ও পারের অস্পষ্ট বনরেখার উপর আর খানিকটা আলো পড়ে, সেইটুকু আলোতে ভালো করিয়া কিছুই দেখা যায় না ; কেবল ও পারের সুদূরতা ও অস্ফুটিতাকে মধুর রহস্যময় করিয়া তোলে। এ পারে নিদ্রার রাজ্য আর ও পারে স্বপ্নের দেশ বলিয়া মনে হইতে থাকে | এই যে-সব গঙ্গার ছবি আমার মনে উঠিতেছে। এ কি সমস্তই এইবারকার স্টীমারযাত্রার ফল ? তাহা নহে । এ-সব কতদিনকার কত ছবি, মনের মধ্যে আঁকা রহিয়াছে। ইহারা বড়ো সুখের ছবি, আজ ইহাদের চারি দিকে অশ্রুজালের স্ফটিক দিয়া বাধাইয়া রাখিয়াছি । এমনতরো শোভা আর এ জন্মে দেখিতে পাইব না । মেরামত শেষ হইয়া গেছে ; যাত্রীদের স্নানাহার হইয়াছে, বিস্তর কোলাহল করিয়া নোঙর তোলা হইতেছে। জাহাজ ছাড়া হইল। বামে মুচিখোলার নবাবের প্রকাণ্ড খাচা ; ডান দিকে শিবপুর বটানিকেল গার্ডেন ।। যত দক্ষিণে যাইতে লাগিলাম, গঙ্গা ততই চওড়া হইতে লাগিল । বেলা দুটা-তিনটের সময় ফলমূল সেবন করিয়া সন্ধ্যাবেলায় কোথায় গিয়া থামা যাইবে তাঁহারই আলোচনায় প্রবৃত্ত হওয়া গেল। আমাদের দক্ষিণে বামে নিশান উড়াইয়া অনেক জাহাজ গোল আসিল- তাহাদের সগর্ব গতি দেখিয়া আমাদের উৎসাহ আরো বাড়িয়া উঠিল । বাতাস যদিও উলটা বহিতেছে, কিন্তু স্রোত আমাদের অনুকূল। আমাদের উৎসাহের সঙ্গে সঙ্গে জাহাজের বেগও অনেক বাড়িয়াছে। জাহাজ বেশ দুলিতে লাগিল। দূর হইতে দেখিতেছি এক-একটা মস্ত ঢেউ ঘােড় তুলিয়া পাশে নিস্ফল রোষে ফেনাইয়া উঠিয়া, গর্জন করিয়া, জাহাজের লোহার। পাজরায় সবলে মাথা ঠুকিতেছে- হতাশ্বাস হইয়া দুই পা পিছাইয়া পুনশ্চ আসিয়া আঘাত করিতেছে- আমরা সকলে মিলিয়া তাঁহাই দেখিতেছি। হঠাৎ দেখি কর্তবাবু মুখ বিবৰ্ণ করিয়া কর্ণধারের কাছে ছুটিয়া যাইতেছেন। হঠাৎ রব উঠিল, “এই এই— রাখা রাখা ! থাম থাম!’ গঙ্গার তরঙ্গ অপেক্ষা প্রচণ্ডতর