পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৬৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

१२० রবীন্দ্র-রচনাবলী তিনি তপস্যা-দ্বারা নিজের রূপকে অবন্ধ্য করিতে ইচ্ছা করিলেন । এবারে গৌরী তরুণার্কারক্তিম বসনে শরীর মণ্ডিত করিলেন না, কৰ্ণে চুতপল্লব এবং অলকে নবকণিকার পরিলেন না ; তিনি কঠোর মীেঞ্জীমেখলা-দ্বারা অঙ্গে বন্ধল বাধিলেন এবং ধ্যানাসনে বসিয়া দীর্ঘ অপাঙ্গে কালিমাপাত করিলেন। বসন্তসখা পঞ্চশর মদনকে পরিত্যাগ করিয়া কঠিন দুঃখকেই তিনি প্রেমের সহায় করিলেন। শকুন্তলাও দিব্য আশ্রমে মদনের মাদকতাগ্রানিকে দুঃখতাপে দগ্ধ করিয়া কল্যাণী তাপসীর বেশে সার্থক প্রেমের প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন । যে ত্ৰিলোচন বসন্তাপুষ্পাভরণা গীেরীকে এক মুহূর্তে প্রত্যাখ্যান করিয়াছিলেন তিনি দিবসের শশিলেখার ন্যায় কৰ্শিতা শ্লথলম্বিতপিঙ্গলজটাধারিণী তপস্বিনীর নিকট সংশয়৷রহিত সম্পূৰ্ণহীদয়ে আপনাকে সমর্পণ করিলেন। লাবণ্যপরাক্রান্ত যৌবনকে পরাকৃত করিয়া পার্বতীর নিরাভরণা মনােময়ী কান্তি অমলা জ্যোতিলেখার মতো উদিত হইল। প্রার্থিতকে সে সৌন্দৰ্য বিচলিত করিল না, চরিতার্থ করিয়া দিল । তাহার মধ্যে লজ-আশঙ্কা আঘাত-আলোড়ন রহিল না ; সেই সৌন্দর্যের বন্ধনকে আত্মা আদরে বরণ করিল ; তাহার মধ্যে নিজের পরাজয় অনুভব করিল না। এতদিন পরে ধর্মেণাপি পদং শর্বে করিতে পার্বতীং প্রতি । পূর্বাপরাধতীতস্য কামস্যোেচ্ছসিতং মনঃ ॥ ধর্ম যখন মহাদেবের মনকে পর্বতীর অভিমুখে আকর্ষণ করিলেন, তখন পূর্বাপরাধতীত কামের মন আশ্বাসে উচ্ছসিত হইয়া উঠিল । ধর্ম যেখানে দুই হৃদয়কে একত্র করে, সেখানে মদনের সহিত কাহারও কোনো বিরোধ নাই। সে যখন ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বাধাইতে চায়, তখনই বিপ্লব উপস্থিত হয়, তখনই প্রেমের মধ্যে ধ্রুবত্ব এবং সৌন্দর্যের মধ্যে শান্তি থাকে না । কিন্তু ধর্মের অধীনে তাহার যে নির্দিষ্ট স্থান আছে সেখানে সেও পরিপূর্ণতার একটি অঙ্গস্বরূপ, সেখানে থাকিয়া সে সুষম ভঙ্গ করে না। কারণ, ধর্মের অর্থই সামঞ্জস্য ; এই সামঞ্জস্য সৌন্দর্যকেও রক্ষা করে, মঙ্গলকেও রক্ষা করে এবং সৌন্দর্য ও মঙ্গলকে অভেদ করিয়া উভয়কে একটি আনন্দময় সম্পূর্ণতা দান করে। সৌন্দর্য যেখানে ইন্দ্রিয়কে ছাড়াইয়া ভাবের মধ্যে গিয়া প্ৰবেশ করে সেখানে বাহ্যসৌন্দর্যের বিধান তাহাতে আর খাটে না । সেখানে তাহার আর ভূষণের প্রয়োজন কী ? প্রেমের মন্ত্রবলে মন যে সৌন্দর্য সৃষ্টি করে তাহাকে বাহ্যসৌন্দর্যের নিয়মে বিচার করাই চলে না। শিবের ন্যায় তপস্বী, গীেরীর ন্যায় কিশোরীর সঙ্গে বাহ্য সৌন্দর্যের নিয়মে ঠিক যেন সংগত হইতে পারেন না । শিব নিজেই ছদ্মবেশে সে কথা তপস্যারতা উমাকে জানাইয়াছেন । উমা উত্তর দিয়াছেন মমাত্ৰ ভবৈকরসং মনঃ স্থিতম, আমার মন তাহাতেই ভােবৈকরস হইয়া অবস্থিতি করিতেছে। এ যে রস, এ ভাবের রস ; সুতরাং ইহাতে আর কথা চলিতে পারে না। মন এখানে বাহিরের উপরে জয়ী ; সে নিজের আনন্দকে নিজে সৃষ্টি করিতেছে। শাস্তুও একদিন বাহ্যসৌন্দর্যকে প্রত্যাখ্যান করিয়াছিলেন ; কিন্তু প্রেমের দৃষ্টি, মঙ্গলের দৃষ্টি, ধর্মের দৃষ্টির দ্বারা যে সৌন্দর্য দেখিলেন, তাহা তপস্যাকৃশ ও আভরণহীন হইলেও তীহাকে জয় করিল। কারণ, সে জয়ে র্তাহার নিজের মনই সহায়তা করিয়াছে, মনের কর্তৃত্ব তাঁহাতে নষ্ট হয় নাই। ধর্ম যখন তাপস তপস্বিনীর মিলনসাধন করিল। তখন স্বৰ্গমর্ত এঁই প্রেমের সাক্ষী ও সহায় -রূপে অবতীর্ণ হইল ; এই প্রেমের আহবান সপ্তর্ষিবৃন্দকে স্পর্শ করিল ; এই প্রেমের উৎসব লোকলোকান্তরে ব্যাপ্ত হইল। ইহার মধ্যে কোনাে গৃঢ় চক্রান্ত, অকালে বসন্তের আবির্ভাব ও গোপনে মদনের শরপাতন রহিল না । ইহার যে অস্নানমঙ্গলীশ্ৰী তাহা সমস্ত সংসারের আনন্দের সামগ্ৰী । সমস্ত বিশ্ব এই শুভমিলনের নিমন্ত্রণে প্ৰসন্নমুখে যোগদান করিয়া ইহাকে সুসম্পন্ন করিয়া দিল । সপ্তম সর্গে সেই বিশ্বব্যাপী উৎসব। এই বিবাহ-উৎসবেই কুমারসম্ভবের উপসংহার।