পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৭১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

প্রাচীন সাহিত্য १२१ স্নেহসেবার কর্মে প্রবৃত্ত। কেবল বন্ধলবসনে নহে, ভাবে ভঙ্গিতেও শকুন্তলা যেন তরুলতার মধ্যেই নাটকের আরম্ভেই শান্তিসৌন্দর্যসংবলিত এমন একটি সম্পূর্ণ জীবন, নিভৃত পুষ্পপল্লবের মাঝখানে প্ৰত্যহিক আশ্রমধর্ম, অতিথিসেবা, সখীমেহ ও বিশ্ববাৎসল্য লইয়া আমাদের সম্মুখে দেখা দিল। তাহা এমনি অখণ্ড, এমনি আনন্দকর যে, আমাদের কেবলই আশঙ্কা হয়, পাছে আঘাত লাগিলেই ইহা ভাঙিয়া যায় ! দুষ্মন্তকে দুই উদ্যত বাহু-দ্বারা প্রতিরোধ করিয়া বলিতে ইচ্ছা হয়, বাণ মারিয়ো না, মারিয়াে না— এই পরিপূর্ণ সৌন্দর্যটি ভাঙিয়ে না। যখন দেখিতে দেখিতে দুষ্মন্ত-শকুন্তলার প্রণয় প্রগাঢ় হইয়া উঠিতেছে তখন প্রথম অঙ্কের শেষে নেপথ্যে অকস্মাৎ আর্তরব উঠিল, ‘ভো ভো তপস্বিগণ, তোমরা তপোবনপ্রাণীদের রক্ষার জন্য সতর্ক হও । মৃগয়াবিহারী রাজা দুষ্মন্ত প্রত্যাসন্ন হইয়াছেন ৷” ইহা সমস্ত তপোবনভূমির ক্ৰন্দন, এবং সেই তপোবনপ্রাণীদের মধ্যে শকুন্তলাও একটি। কিন্তু তাহাকে কেহ রক্ষা করিতে পারিল না । সেই তপোবন হইতে শকুন্তলা যখন যাইতেছে, তখন কশ্ব ডাক দিয়া বলিলেন, “ওগো সন্নিহিত তপোবন-তরুগণ— তোমাদের জল না করি দান যে আগে জল না করিত পান, সাধ ছিল যার সাজিতে, তবু স্নেহে পাতাটি না ছিড়িত কতু, তোমাদের ফুল ফুটিত যাবে যে জন মাতিত মহােৎসবে, পতিগৃহে সেই বালিকা যায়, তোমরা সকলে দেহ বিদায় ।” চেতন-অচেতন সকলের সঙ্গে এমনি অন্তরঙ্গ আত্মীয়তা, এমনি প্রীতি ও কল্যাণের বন্ধন ! শকুন্তলা কহিল, ‘হলা প্রিয়ংবাদে, আর্যপুত্রকে দেখিবার জন্য আমার প্রাণ আকুল, তবু আশ্রম ছাড়িয়া যাইতে আমার পা যেন উঠিতেছে না।” প্রিয়ংবদা কহিল, ‘তুমিই যে কেবল তপোবনের বিরহে কাতর, তাহা নহে, তোমার আসন্নবিয়োগে তপোবনেরও সেই একই দশা মৃগের গলি পড়ে মুখের তৃণ ময়ূর নাচে না যে আর, খসিয়া পড়ে পাতা লতিকা হতে যেন সে আঁখিজলধারা ।” শকুন্তলা কশ্বকে কহিল, ‘তাঁত, এই-যে কুটিরপ্রান্তচারিণী গর্ভমন্থরা মৃগবধূ, এ যখন নির্বিঘ্নে প্রসব করিবে তখন সেই প্রিয় সংবাদ নিবেদন করিবার জন্য একটি লোককে আমার কাছে পাঠাইয়া দিয়ে।” কথা কহিলেন, “আমি কখনো ভুলিব না।”