পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৯৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

QQ8 রবীন্দ্র-রচনাবলী শিব গেল শ্বশুরবাড়ি, বসতে দিল পিড়ে। জলপান করিতে দিল শালিধানের চিড়ে ৷ শালিধানের চিড়ে নয় রে, বিন্নিধানের খই। মোটা মোটা সবরি কলা, কাগমারে দই ৷ ভাবে-গতিকে আমার সন্দেহ হইতেছে শিবুঠাকুর এবং শিবুসদাগর লোকটি একই হইবেন । দাম্পত্য সম্বন্ধে উভয়েরই একটু বিশেষ শখ আছে এবং বােধ করি আহার সম্বন্ধেও অবহেলা নাই। উপরন্তু গঙ্গার মাঝখানটিতে যে স্থানটুকু নির্বাচন করিয়া লওয়া হইয়াছে তাহাও নবপরিণীতের প্রথম প্ৰণয়যাপনের পক্ষে অতি উপযুক্ত স্থান । এই স্থলে পাঠকগণ লক্ষ করিয়া দেখিবেন, প্রথমে অনবধানতাক্রমে শিবুসদাগরের জলপানের স্থলে শালিধানের চিড়ার উল্লেখ করা হইয়াছিল, কিন্তু পরীক্ষণেই সংশোধন করিয়া বলা হইয়াছে “শালিধানের চিড়ে নয় রে, বিন্নিধানের খই । যেন ঘটনার সত্য সম্বন্ধে তিলমাত্র স্বলন হইবার জো নাই। অথচ এই সংশোধনের দ্বারা বর্ণিত ফলহারের খুব যে একটা ইতারবিশেষ হইয়াছে, জামাই-আন্দর, সম্বন্ধে শ্বশুরবাড়ির গীেরব খুব উজ্জ্বলতররূপে পরিস্ফুট হইয়া উঠিয়াছে তাহাও বলিতে পারি না। কিন্তু এ ক্ষেত্রে শ্বশুরবাড়ির মর্যাদা অপেক্ষা সত্যের মর্যাদা রক্ষার প্রতি কবির অধিক লক্ষ দেখা যাইতেছে। তাও ঠিক বলিতে পারি না । বোধ করি ইহাও স্বপ্নের মতো । বোধ করি শালিধানের চিড়া দেখিতে দেখিতেই পরমুহুর্তে বিন্নিধানের খই হইয়া উঠিয়াছে। বােধ করি শিবুঠাকুরও কখন এমন করিয়া শিবুসদাগরে পরিণত হইয়াছে কেহ বলিতে পারে না । শুনা যায় মঙ্গল ও বৃহস্পতির কক্ষ-মধ্যে কতকগুলি টুকরা গ্ৰহ আছে। কেহ কেহ বলেন একখানা আস্ত গ্ৰহ ভাঙিয়া খণ্ড খণ্ড হইয়া গিয়াছে। এই ছড়াগুলিকেও সেইরূপ টুকরা জগৎ বলিয়া আমার মনে হয়। অনেক প্রাচীন ইতিহাস প্রাচীন স্মৃতির চূর্ণ অংশ এই সকল ছড়ার মধ্যে বিক্ষিপ্ত হইয়া আছে, কোনো পুরাতত্ত্ববিৎ আর তাহাদিগকে জোড়া দিয়া এক করিতে পারেন না, কিন্তু আমাদের কল্পনা এই ভগ্নাবশেষগুলির মধ্যে সেই বিস্মৃত প্রাচীন জগতের একটি সুদূর অথচ নিকট পরিচয় লাভ করিতে চেষ্টা করে । অবশ্য বালকের কল্পনা এই ঐতিহাসিক ঐক্য রচনার জন্য উৎসুক নহে। তাহার নিকট সমস্তই বর্তমান এবং তাহার নিকট বর্তমানেরই গৌরব । সে কেবল প্ৰত্যক্ষ ছবি চাহে এবং সেই ছবিকে ভাবের অশ্রুবাম্পে ঝাপসা করিতে চাহে না । নিম্নোদধূত ছড়াটিতে অসংলগ্ন ছবি যেন পাখির বঁাকের মতো উড়িয়া চলিয়াছে। ইহাদের প্রত্যেকের এই স্বতন্ত্র দ্রুতগতিতে বালকের চিত্ত উপযুপরি নব নব আঘাত পাইয়া বিচলিত হইতে থাকে । নোটন নোটন পায়রাগুলি বেঁটন রেখেছে। বড়ো সাহেবের বিবিগুলি নাইতে এসেছে ৷ দু পারে দুই রুই কাৎলা ভেসে উঠেছে। দাদার হাতে কলম ছিল ছুড়ে মেরেছে ৷ ও পারেতে দুটি মেয়ে নাইতে নেবেছে। ঝুনু কুনু চুলগাছটি ঝাড়তে নেগেছে ৷ ] কে রেখেছে, কে রেখেছে, দাদা রেখেছে। আজ দাদার ঢেলা ফেলা, কাল দাদার বে। ॥ দাদা যাবে কোন খান দে, বুকলতলা দে ৷ বকুলফুল কুড়তে কুড়তে পেয়ে গেলুম মালা। রামধনুকে বাদি বাজে, সীতেনাথের খেলা ৷ সীতেনাথ বলে রে ভাই, চালকড়াই খাব।