পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৩৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Գ Տ8 রবীন্দ্র-রচনাবলী অপেক্ষা রাখে ; সেইজন্যই বাঙালির কাছে ইহার একটি বিশেষ রস আছে। বৈষ্ণবী যখন “জয় রাধে বলিয়া ভিক্ষা করিতে অন্তঃপুরের আঙিনায় আসিয়া দাঁড়ায় তখন কুতুহলী গৃহকত্রী এবং অবগুষ্ঠিত বধূগণ তাহা শুনিবার জন্য উৎসুক হইয়া আসেন। প্ৰবীণা পিতামহী, গল্পে গানে ছড়ায় যিনি আকণ্ঠ পরিপূর্ণ, কত শুক্লপক্ষের জ্যোৎস্নায় ও কৃষ্ণপক্ষের তারার আলোকে তঁহাকে উত্তাক্ত করিয়া তুলিয়া গৃহের বালকবালিকা যুবকযুবতী একাগ্রমনে বহুশত বৎসর ধরিয়া যাহা শুনিয়া আসিতেছে বাঙালি পাঠকের নিকট তাহার রস গভীর এবং অক্ষয় । গাছের শিকড়টা যেমন মাটির সঙ্গে জড়িত এবং তাহার অগ্রভাগ আকাশের দিকে ছড়াইয়া পডিয়াছে, তেমনি সর্বত্রই সাহিত্যের নিম্ন-অংশ স্বদেশের মাটির মধ্যেই অনেক পরিমাণে জড়িত হইয়া ঢাকা থাকে ; তাহা বিশেষরূপে সংকীর্ণরূপে দেশীয়, স্থানীয় । তাহা কেবল দেশের জনসাধারণেই উপভোগ্য ও আয়ত্তগম্য, সেখানে বাহিরের লোক প্রবেশের অধিকার পায় না | সাহিত্যের যে অংশ সার্বভৌমিক তাহা এই প্রাদেশিক নিম্নস্তরের থাকটার উপরে দাড়াইয়া আছে। এইরূপ নিম্নসাহিত্য এবং উচ্চসাহিত্যের মধ্যে বরাবর ভিতরকার একটি যোগ আছে। যে অংশ আকাশের দিকে আছে তাহার ফুলফল-ডালপালার সঙ্গে মাটির নীচেকার শিকড়গুলার তুলনা হয় না— তবু তত্ত্ববিদদের কাছে তাহাদের সাদৃশ্য ও সম্বন্ধ কিছুতেই ঘূচিবার নহে নীচের সহিত উপরের এই-যে যোগ, প্রাচীন বঙ্গসাহিত্য আলোচনা করিলে ইহা স্পষ্ট দেখিতে পাওয়া যায়। অন্নদামঙ্গুল ও কবিকঙ্কণের কবি যদিচ্চ রাজসভা-ধনীসভার কবি, যদিচ তাহারা উভয়ে পণ্ডিত, সংস্কৃত কাব্যসাহিত্যে বিশারদ, তথাপি দেশীয় প্রচলিত সাহিত্যকে বেশি দূর ছাড়াইয়া যাইতে পারেন নাই। অন্নদামঙ্গল ও কুমারসম্ভবের আখ্যানে প্রভেদ অল্প, কিন্তু অন্নদামঙ্গল কুমারসম্ভবের ছাচে গড়া হয় নাই । তাহার দেবদেবী বাংলাদেশের গ্ৰাম্য হরগৌরী | কবিকঙ্কণ চণ্ডী, ধর্মমঙ্গল, মনসার ভাসান, সত্যপীরের কথা, সমস্তই গ্ৰাম্যকাহিনী অবলম্বনে রচিত । সেই গ্ৰাম্য ছড়াগুলির পরিচয় পাইলে তবেই ভারতচন্দ্র-মুকুন্দরাম-রচিত কাব্যের যথার্থ পরিচয় পাইবার পথ হয়। রাজসভার কাব্যে ছন্দ মিল ও কাব্যকলা সুসম্পূর্ণ সন্দেহ নাই, কিন্তু গ্ৰাম্য ছড়াগুলির সহিত তাহার মর্মগত প্রভেদ ছিল N আমার হাতে যে ছড়াগুলি সঞ্চিত হইয়াছে তাহা অপেক্ষাকৃত পুরাতন কি নূতন নিঃসন্দেহ বলিতে পারি না । কিন্তু দু-এক শত বৎসরে এ-সকল কবিতার বয়সের কমিবেশি হয় না। আজ পঞ্চাশ বৎসর পূর্বে পল্লীর কবি যে ছড়া রচনা করিয়াছে তাহাকে এক হিসাবে মুকুন্দরামের সমসাময়িক বলা যায় ; কারণ, গ্রামের প্রাণটি যেখানে ঢাকা থাকে কালস্রোতের ঢেউগুলি সেখানে তেমন জোরের সঙ্গে ঘা দিতে পারে না । গ্রামের জীবনযাত্রা এবং সেই জীবনযাত্রার সঙ্গী সাহিত্য বহুকাল বিনা পরিবর্তনে একই ধারায় চলিয়া আসে । কেবল সম্প্রতি আতি অল্পদিন হইল আধুনিক কাল, দূরদেশগত নবীন জামাতার মতো নূতন চাল-চলন লইয়াপল্লীর অন্তঃপুরেও প্রবেশ করিয়াছে। গ্রামের মধ্যেও পরিবর্তনের হাত পড়িয়াছে । এজন্য গ্ৰাম্য ছড়া -সংগ্রহের ভার র্যাহারা লইয়াছেন তাহারা আমাকে লিখিতেছেন “প্ৰাচীনা ভিন্ন আজকালকার মেয়েদের কাছে এইরূপ কবিতা শুনিবার প্রত্যাশা নাই। তাহারা ইহা জানে না এবং জানিবার কৌতুহলও রাখে না। বষীয়সী স্ত্রীলোকের সংখ্যা খুব কম। র্তাহাদের মধ্যেও অনেকে উহা জানেন না। দুই-একজন জানিলেও সকলে জানেন না। সুতরাং পাঁচটি ছড়া সংগ্ৰহ করিতে হইলে পাচ গ্রামের পাঁচজন বৃদ্ধর আশ্রয় লইতে হয়। এ দেশের পুরাতন বৈষ্ণবীগণের দুই-একজন মাঝে মাঝে এইরূপ কবিতা বলিয়া ভিক্ষা করে দেখিতে পাই। তাঁহাদের কথিত ছড়াগুলি সমস্তই রাধাকৃষ্ণের প্রেম-বিষয়ক । এইরূপ বৈষ্ণবী সচরাচর মেলে না এবং মিলিলেও অনেকেই একবিধ ছড়াই গাহিয়া থাকে। এমতস্থলে একাধিক নূতন ছড়া সংগ্ৰহ করিতে হইলে অপেক্ষাকৃত বহু বৈষ্ণবীর সাহায্য আবশ্যক। তবে শস্যশ্যামলা মাতৃভূমির কৃপায় প্রতি সপ্তাহে অন্তত দুই-একটি বিদেশিনী নূতন বৈষ্ণবীর ‘জয় রাধে রব শুনিতে পাওয়া বড়ো কিছু আশ্চর্যের বিষয় নহে ।”