পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৫৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গ্রন্থপরিচয় by S \) কাজে পড়িয়া, ভাবনায় পড়িয়া সময়ের প্রভাবে আমরা তাে সহজেই বুড়ো হইয়া পড়িতেছি, এজন্য কাহাকেও অধিক আয়ােজন করিতে হয় না। ইহার উপরেও যদি খেলার সময়, আমোদের সময়, আমরা ইচ্ছা করিয়া বুড়োমির চর্চা করি, তবে যৌবনকে গলা টিপিয়া বধ করা হয়। ।। যতদিন যৌবন থাকে ততদিন উৎসাহ থাকে, প্রতি মুহুর্তে হৃদয় বাড়িতে থাকে, নূতন নূতন ভাব নূতন নূতন জ্ঞান সহজে গ্রহণ করিতে পারি— নূতন কাজ করিতে অনিচ্ছা বােধ হয় নাবিশ্বসুদ্ধ লোক এবং অনুষ্ঠানের উপর অবিশ্বাস জন্মে না— আশা উদ্যমকে বিসর্জন দিয়া পরম বিজ্ঞা হইয়া তাম্রকুটের ধূম ও পরনিন্দা লইয়া দাওয়ায় বসিয়া একাধিপত্য করিতে ইচ্ছা যায় না। হৃদয়ের যৌবন চলিয়া গেলে হৃদয়ের বৃদ্ধি আর হয় না, শামুকের মতো জড়তার খোলার মধ্যে সংকুচিত হইয়া বাস করিতে হয়, আপনাকে এমনি মন্ত লোক বলিয়া বোধ হয় যে দাম্ভিক কোনো কাজ দেখিলে অত্যন্ত হাসি আসে । বিশুদ্ধ আমোদ-প্ৰমোদ মাত্রকেই আমরা ছেলেমানুষ জ্ঞান করি— বিজ্ঞলোকের, কাজের লোকের পক্ষে সেগুলো নিতান্ত অযোগ্য বলিয়া বােধ হয়। কিন্তু ইহা আমরা বুঝি না যে, যাহারা বাস্তবিক কাজ করিতে জানে তাহারাই আমোদ করিতে জানে। যাহারা কাজ করে না তাহারা আমোদও করে না । ইংরাজেরা কাজ না করিয়া থাকিতে পারে না, আমোদ নহিলেও তাঁহাদের চলে না । ইংরাজেরা জ্ঞানে বৃদ্ধের মতো, কাজে যুবার মতো, খেলায় বালকের মতো । আসল কথা এই যে, বালকের মতো না খেলিলে যুবার মতো কাজ করা যায় না, যুবার মতো কাজ না করিলে বৃদ্ধের মতো জ্ঞান পাকিয়া উঠে না। ক্ষেত্রেই যেমন শস্য পাকিয়া থাকে, গোলাবাড়িতে পাকে না, তেমনি কাৰ্যক্ষেত্রেই জ্ঞান পাকিয়া থাকে- জড়তার মধ্যে তাম্রকুটের ধোয়ায় পাকিয়া উঠে না । মানুষের মতো মানুষ হইতে গেলে বালক বৃদ্ধ যুবা এই তিনই হইতে হয় । কেবলই বৃদ্ধ হইতে গেলে বিনাশ পাইতে হয়, কেবলই বালক হইতে গেলে উন্নতি হয় না। আমরা বাঙালিরা যদি যথার্থ মহৎ জাতি হইতে চাই। তবে আমরা খেলাও করিব, কাজও করিব, চিন্তা করিব । আমরা প্ৰফুল্ল হইয়া খেলা করিব, উদ্যোগী হইয়া কাজ করিব ও গভীর হইয়া চিন্তা করিব । ইংরেজদের “শারাড'-নামক একপ্রকার খেলা আছে, আমরা বাংলায় তাহাকে হেঁয়ালি-নাট্য বলিলাম। তাহার মর্মটা বলিয়া দিই। দুই-তিনজন লোকে ষড়যন্ত্র করিয়া এমন একটা কথা - বাহির করিতে হইবে যাহা দুই-তিন ভাগে ভাঙিয়া ফেলা যাইতে পারে। প্রত্যেক ভাগের একটা অর্থ থাকা চাই । মনে করে ‘পাগোল শব্দ । এই শব্দকে পা এবং গোল এই দুই ভাগে ভাগ করিলে প্রত্যেক ভাগের একটা অর্থ পাওয়া যায়। তার পর উপস্থিতমত মুখে মুখে একটা নাটক বানাইয়া লইতে হইবে ; সেই নাটকের মধ্যে কোনো স্থানে কথায় কথায় পা শব্দ এবং গোল শব্দ, এবং পাগল শব্দের সমস্তটা ব্যবহার করিতে হইবে, পরে শ্রোতারা আন্দাজ করিয়া বলিয়া দিবেন। কোন শব্দ অবলম্বন করিয়া এই নাটাভিনয় করা হইল। না বলিতে পারিলে তীহাদের হার হইল । আমরা নিম্নে হেঁয়ালি-নাট্যের একটা উদাহরণ দিতেছি। পাঁচজন কিংবা চারজনে মিলিয়া এই হেঁয়ালি-নাটা অভিনয় করবেন, এবং বাকি সকলকে এই নাটাের মধ্যে প্রচ্ছন্ন শব্দটা বাহির করিয়া দিতে হইবে । —বালক । জ্যৈষ্ঠ ১২৯২, পৃ. ৮৮-৮৯