পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৫৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

૭8૨ রবীন্দ্র-রচনাবলী ব্যাপারের চেয়ে বৃহত্তম—এবং নিজ নিজ কর্মোদযোগের আকর্ষণই জগতের আর সমস্ত মহৎ আকর্ষণের চেয়ে আমাদের কাছে মহত্তম হইয়া উঠে। এমন সময় নীলাম্বর রাত্রি নিঃশবপদে আসিয়া নিখিলের উপরে স্নিগ্ধ করম্পর্শ করিবামাত্র আমাদের পরস্পরের বাহপ্রভেদ অস্পষ্ট হইয়া আসে—তখন আমাদের পরস্পরের মধ্যে গভীরতম যে ঐক্য, তাহাই অন্তরের মধ্যে অনুভব করিবার অবকাশ ঘটে । এইজন্য রাত্রি প্রেমের সময়, মিলনের কাল । ইহাই ঠিক করিয়া বুঝিতে পারিলে জানিব--দিন আমাদিগকে যাহা দেয়, রাত্রি শুদ্ধমাত্র যে তাহা অপহরণ করে, তাহা নহে, অন্ধকার যে কেবলমাত্র অভাব ও শূন্ততা আনয়ন করে, তাহা নহে—তাহারও দিবার জিনিস আছে এবং যাহা দেয়, তাহ মহামূল্য। সে যে কেবল সুপ্তির দ্বারা আমাদের ক্ষতিপূরণ করে,—আমাদের ক্লাস্তি অপনোদন করিয়া দেয় মাত্র, তাহা নহে। সে আমাদের প্রেমের নিভৃত নির্ভরস্থান ; সে আমাদের মিলনের মহাদেশ । শক্তিতে আমাদের গতি, প্রেমে আমাদের স্থিতি । শক্তি কর্মের মধ্যে আপনাকে ধাবিত করে, প্রেম বিশ্রামের মধ্যে আপনাকে পুঞ্জীভূত করে। শক্তি আপনাকে বিক্ষিপ্ত করিতে থাকে—সে চঞ্চল, প্রেম আপনাকে সংহত করিয়া আনে—সে স্থির । আমাদের চিত্ত যাহাদিগকে ভালোবাসে, সংসারে কেবল তাহাদেরই মধ্যে সে বিরামলাভ করে, আমাদের চিত্ত যখন বিশ্রামের অবকাশ পায়, তখনই সে সম্পূর্ণভাবে ভালোবাসিতে পারে। জগতে আমাদের যথার্থ যে বিরাম, তাহা প্রেম ;—প্রেমহীন যে বিরাম, তাহ জড়ত্বমাত্র । এই কারণে কৰ্মশালা প্রকৃত মিলনের স্থান নহে, স্বার্থে আমরা একত্র হইতে পারি, কিন্তু এক হইতে পারি না । প্রভূতৃত্যের মিলন সম্পূর্ণ মিলন নহে, বন্ধুদের মিলনই সম্পূর্ণ মিলন। বন্ধুত্বের মিলন বিশ্রামের মধ্যে বিকশিত হয়—তাহাতে কর্মের তাড়না নাই, তাহাতে প্রয়োজনের বাধ্যতা নাই। তাহা অহেতুক । এইজন্য দিবাবসানে আমাদের প্রয়োজন যখন শেষ হয়, আমাদের কর্মের বেগ যখন শাস্ত হয়, তখনই সমস্ত আবস্তকের অতীত যে প্রেম, সে আপনার যথার্থ অবকাশ পায় । আমাদের কর্মের সহায় যে ইন্দ্ৰিয়বোধ সে যখন অন্ধকারে আবৃত হইয় পড়ে, তখন ব্যাঘাতহীন আমাদের হৃদয়ের শক্তি বাড়িয়া উঠে, তখন আমাদের জেহুপ্রেম সহজ হয়— আমাদের মিলন সম্পূর্ণ হয়। তাই বলিতেছিলাম, রাত্রি যে কেবল হরণ করে, তাহা নহে, সে দানও করে । আমাদের এক যায়, আমরা আর পাই ; এবং যায় বলিয়াই আমরা তাহ পাইতে পারি।