পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৫৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

O88 রবীন্দ্র-রচনাবলী VO) ঘোড়া সৃষ্টির কাজ প্রায় শেষ হয়ে যখন ছুটির ঘণ্টা বাজে বলে, হেনকালে ব্ৰহ্মার মাথায় একটা ভাবোদয় शक् । ভাগুরীকে ডেকে বললেন, “ওহে ভাণ্ডারী, আমার কারখানাঘরে কিছু কিছু পঞ্চভূতের জোগাড় করে আনো, আর-একটা নতুন প্ৰাণী সৃষ্টি করব।” ভাণ্ডারী হাত জোড় করে বললে, “পিতামহ, আপনি যখন উৎসাহ করে হাতি গড়লেন, তিমি গড়লেন, অজগর সর্পগড়লেন, সিংহ ব্যাঘ্ৰ গড়লেন, তখন হিসাবের দিকে আদৌ খেয়াল করলেন না। যতগুলো ভারী আর কড়া জাতের ভূত ছিল সব প্রায় নিকাশ হয়ে এল। ক্ষিতি অপ তেজ তলায় এসে ঠেকেছে। থাকবার মধ্যে আছে। মরুৎ ব্যোম, তা সে যত চাই ।” চতুমুখ কিছুক্ষণ ধরে চারজোড়া গোফে তা দিয়ে বললেন, “আচ্ছা ভালো, ভাণ্ডারে যা আছে তাই নিয়ে এসো, দেখা যাক ৷” এবারে প্রাণীটিকে গড়বার বেলা ব্ৰহ্মা ক্ষিতি-আপ-তেজটাকে খুব হাতে রেখে খরচ করলেন। তাকে না দিলেন শিঙ, না দিলেন নখ ; আর দাঁত যা দিলেন তাতে চিবানো চলে, কামড়ানো চলে না। তেজের ভাণ্ড থেকে কিছু খরচ করলেন বটে, তাতে প্রাণীটা যুদ্ধক্ষেত্রের কোনো কোনো কাজে লাগাবার মতো হল কিন্তু তার লড়াইয়ের শখ রইল না। এই প্ৰাণীটি হচ্ছে ঘোড়া। এ ডিম পাড়ে না। তবু বাজারে তার ডিম নিয়ে একটা গুজব আছে, তাই একে দ্বিজ বলা চলে । আর যাই হােক, সৃষ্টিকর্তা এর গড়নের মধ্যে মরুৎ। আর ব্যোম একেবারে ঠেসে দিলেন । ফল হল এই যে, এর মনটা প্রায় ষোলো-আনা গেল মুক্তির দিকে। এ হাওয়ার আগে ছুটতে চায়, অসীম আকাশকে পেরিয়ে যাবে বলে পণ করে বসে। অন্য সকল প্ৰাণী কারণ উপস্থিত হলে দৌড়য় ; এ দীেড়য় বিনা কারণে ; যেন তার নিজেই নিজের কাছে থেকে পালিয়ে যাবার একান্ত শখ। কিছুকাড়তে চায় না, কাউকে মারতে চায় না, কেবলই পালাতে চায়- পালাতে পালাতে একেবারে বুদ হয়ে যাবে, ঝিম হয়ে যাবে, ভেঁা হয়ে যাবে, তার পরে 'না' হয়ে যাবে, এই তার মতলব । জ্ঞানীরা বলেন, ধাতের মধ্যে মরুৎ বোম যখন ক্ষিতি-আপ-তেজকে সম্পূর্ণ ছাড়িয়ে ওঠে তখন এই রকমই ঘটে । ব্ৰহ্মা বড়ো খুশি হলেন : বাসার জন্যে তিনি অন্য জন্তুর কাউকে দিলেন বন, কাউকে দিলেন গুহা, কিন্তু এর দৌড় দেখতে ভালোবাসেন বলে একে দিলেন খোলা মাঠ । মাঠের ধারে থাকে মানুষ। কাঁড়াকুড়ি করে সে যা-কিছু জমায় সমস্তই মন্ত বোঝা হয়ে ওঠে। তাই যখন মাঠের মধ্যে ঘোড়াটাকে ছুটতে দেখে মনে মনে ভাবে, এটাকে কোনো গতিকে বাঁধতে পারলে আমাদের হাট করার বড়ো সুবিধে ।” ফাস লাগিয়ে ধরলে একদিন ঘোড়াটাকে । তার পিঠে দিলোজিন, মুখে দিলে কঁটা-লাগাম। ঘাড়ে তার লাগায় চাবুক আর কাখে মারে জুতোর শেল। তা ছাড়া আছে দালা-মলা । মাঠে ছেড়ে রাখলে হাতছাড়া হবে, তাই ঘোড়াটার চারিদিকে পাচিল তুলে দিলে। বাঘের ছিল বন, তার বনই রইল ; সিংহের ছিল গুহা, কেউ কাড়ল না। কিন্তু, ঘোড়ার ছিল খোলা মাঠ, সে এসে ঠেকাল আস্তাবলে। প্রাণীটাকে মরুৎ বোম মুক্তির দিকে অত্যন্ত উসকে দিলে, কিন্তু বন্ধন থেকে বাচাতে পারলে না । যখন অসহ্য হল তখন ঘোড়া তার দেয়ালটার পরে লাথি চালাতে লাগল। তার পা যতটা জখম হল দেয়াল ততটা হল না ; তবু, চুন বালি খসে দেয়ালের সৌন্দৰ্য নষ্ট হতে লাগল।