পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫১৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

* গ্যাস 8 বুক ফুলিয়ে দেয় না দেখা, গোপনে রায় এক এক, নিচু হয়ে সবার উপর ও যে। বনের ও তো আদুরে নয়, শক্ত হয়ে দাড়িয়ে রয়, গায়েতে ওর নাইকো অলংকার ; রস জোগায় সোচুপে চুপে, থাকে নিজে নীরস রূপে, আপনি জোরে বহে আপন ভার । কাটা যখন উচিয়ে থাকে অহিংস্র কেউ কয় না। তাকে যতই কিন্তু করুক-না বদনাম, পশুর কামড় থেকে যারে বঁচিয়ে রাখে বারে বারে সেই তো জানে কাটার কত দাম । বাচস্পতি দাদামশায়, তুমি তোমার চার দিকে যে-সব পাগলের দল জমিয়েছিলে, গুণ হিসেব করে তাদের বুঝি সব নম্বর দিয়ে রেখেছিলে ? হ্যা, তা করতে হয়েছে বৈকি। কম তো জমে নি । তোমার পয়লা নম্বর ছিলেন বাচস্পতি মশায়, তাকে আমার ভারি মজা লাগে । আমার শুধু মজা লাগে না, আশ্চর্য লাগে। কারণ বলি- কবিতা লিখে থাকি। কথা বঁকানো-চোরানো আমাদের ব্যাবসা । যে শব্দের কোনো সাদা মানে আছে তাকে আমরা ধ্বনি লাগিয়ে তার চেহারা বদল করি । সে এক রকমের জাদুবিদ্যা বললেই হয়। কাজটা সহজ নয়। আমাদের বাচস্পতি আমাকে আশ্চৰ্য্য করে দিয়েছিলেন যখন দেখলুম। তিনি একেবারে গোড়াগুড়ি ভাষা বানিয়েছেন । কান দিয়ে ধ্বনির রাস্তায় তার মানের রাস্তা খুঁজতে হয় ; আমাদের কাজটাও অনেকটা তাই, কিন্তু এতদূর পর্যন্ত নয়। আমরা তবু ব্যাকরণ অভিধান মেনে চলি । বাচস্পতির ভাষা চলত সে-সমস্তই ডিঙিয়ে । শুনলে মনে হত যেন কী একটি মানে আছে! মানে ছিল বৈকি। কিন্তু, সেটা কানের সঙ্গে ধ্বনি মিলিয়ে আন্দাজ করতে হত। আমার ‘অদ্ভূত-রত্নাকর সভার প্রধান পণ্ডিত ছিলেন বাচস্পতি মশায়। প্ৰথম বয়সে পড়াশুনা করেছিলেন বিস্তর, তাতে মনের তলা পর্যন্ত গিয়েছিল ঘুলিয়ে । হঠাৎ এক সময়ে ঠার মনে হল, ভাষার শব্দগুলো চলে অভিধানের আঁচল ধরে । এই গোলামি ঘটেছে ভাষার কলিযুগে। সত্যযুগে শব্দগুলো আপনি উঠে পড়ত মুখে । সঙ্গে সঙ্গেই মানে আনত টেনে । তিনি বলতেন, শব্দের আপনি কাজই হচ্ছে বোঝানো, তাকে আবার বোঝাবে কে । একদিন একটা নমুনা শুনিয়ে তাক লাগিয়ে দিলেন। বললেন, আমার নায়িকা যখন নায়ককে বলেছিল হাত নেড়ে দিন রাত তোমার ঐ হিন্দুহিদ হিন্দিকারে আমার পাজপ্তরিতে তিড়িতঙ্ক লাগে, তখন তার মানে বোঝাতে পণ্ডিতকে ডাকতে হয় নি। যেমন পিঠে কিল মেরে সেটাকে কিল প্ৰমাণ করতে মহামহোপাধ্যায়ের দরকার হয় না ।