পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৫৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(ዽX9br রবীন্দ্র-রচনাবলী ভাসছে। আজকাল শুনতে পাই পৃথিবীতে স্থানাভাব নিয়েই লড়াই বাধে। নক্ষত্রদের মাঝখান কিছুমাত্র যদি জায়গার টানাটানি থাকত তা হলে সর্বনেশে ঠোকাঠুকিতে বিশ্ব যেত চুরমার হয়। চোখে দেখার যুগ থেকে এল দূরবীনের যুগ। দুরবীনের জোর বাড়তে বাড়তে বেড়ে চলল দুলোকে আমাদের দৃষ্টির পরিধি। পূর্বে যেখানে ফাক দেখেছি সেখানে দেখা দিল নক্ষত্রের বাক । তবু বাকি রইল অনেক । বাকি থাকবারই কথা। আমাদের নাক্ষত্ৰজগতের বাইরে এমন সব জগৎ আছে যাদের আলো দূরবীনদৃষ্টিরও অতীত। একটা বাতিল শিখা ৮৫৭৫ মাইল দূরে যেটুকু দীপ্তি দেয়। এমনতরো আভাকে দুরবীন যোগে ধরবার চেষ্টায় হার মানলে মানুষের চক্ষু। দূরবীন আপন শক্তি অনুসারে খবর এনে দেয় চোখে, চোখের যদি শক্তি না থাকে সেই অতিক্ষীণ খবরটুকু বোধের কোঠায় চালান করে দিতে, তা হলে আর উপায় থাকে না । কিন্তু ফোটোগ্রাফ-ফলকের আলো-ধরা শক্তি চোখের শক্তির চেয়ে ঢের বেশি স্থায়ী। সেই শক্তির উদবোধন করলে বিজ্ঞান, দূরতম আকাশে জাল ফেলবার কাজে লাগিয়ে দিলে ফোটােগ্রাফ । এমন ফোটোগ্রাফি বানালে যা অন্ধকারে-মুখঢাকা আলোর উপর সমান জারি করতে পারে। দূরবীনের সঙ্গে ফোটােগ্রাফি, ফোটােগ্রাফির সঙ্গে বর্ণলিপির্যন্ত্র জুড়ে দিলে। সম্প্রতি এর শক্তি আরো বিচিত্র করে তোলা হয়েছে। সূর্যে নানা পদার্থ গ্যাস হয়ে জ্বলছে । তারা সকলে একসঙ্গে মিলে যখন দেখা দেয়। তখন ওদের তন্ন তন্ন করে দেখা সম্ভব হয় না ; সেইজন্যে এক আমেরিকান বিজ্ঞানী সূর্য দেখা দূরবীন বানিয়েছেন যাতে জ্বলন্ত গ্যাসের সবরকম রঙ থেকে এক-একটি রঙের আলো ছাড়িয়ে নিয়ে তার সাহায্যে সূর্যের সেই বিশেষ গ্যাসীয় রূপ দেখা সম্ভব হয়েছে। ইচ্ছামত কেবলমাত্র জ্বলন্ত ক্যালসিয়মের রঙ কিংবা জ্বলন্ত হাইড্রোজেনের রঙে সূর্যকে দেখতে পেলে তার গ্যাসীয় অগ্নিকাণ্ডের অনেক খবর মেলে যা আর কোনো উপায়ে পাওয়া যায় না ; সাদা আলো ভাগ করতে পারলে তার বর্ণসপ্তকের এক দিকে পাওয়া যায় লাল অন্য দিকে বেগনি- এই দুই সীমাকে ছাড়িয়ে চলেছে যে আলো সে আমাদের চোখে পড়ে না। ঘন নীলরঙের আলোর ঢেউয়ের পরিমাপ এক ইঞ্চির দেড়কোটি ভাগের এক ভাগ । অর্থাৎ এই আলোর রঙে যে ঢেউ খেলে তার একটা ঢেউয়ের চুড়া থেকে পরবর্তী ঢেউয়ের চুড়ার মােপ এই ! এক ইঞ্চির মধ্যে রয়েছে দেড়কোটি ঢেউ । লাল রঙের আলোর ঢেউ প্ৰায় এর দ্বিগুণ লম্বা। একটা তপ্ত লোহার জ্বলন্ত লাল আলো যখন ক্রমেই নিভে আসে, আর দেখা যায় না, তখনো আরো বড়ো মাপের অদৃশ্য আলো তার থেকে ঢেউ দিয়ে উঠতে থাকে। আমাদের দৃষ্টিকে সে যদি জাগিয়ে তুলতে পারত তা হলে সেই লাল-উজানি রঙের আলোয় আমরা নিভে-আসা লোহাকে দেখতে পেতুম, তা হলে গরমিকালের সন্ধ্যাবেলার অন্ধকারে রৌদ্র মিলিয়ে গেলেও লালউজানি আলোয় গ্ৰীষ্মতপ্ত পৃথিবী আমাদের কাছে আভাসিত হয়ে দেখা দিত । একান্ত অন্ধকার বলে কিছুই নেই। যাদের আমরা দেখতে পাই নে তাদেরও আলো আছে । নক্ষত্ৰলোকের বাহিরের নিবিড় কালো আকাশেও অনবরত নানাবিধ কিরণ বিকীর্ণ হচ্ছে। এই সকল অদৃশ্য দূতকেও দৃশ্যপটে তুলে তাদের কাছ থেকে গোপন অস্তিত্বের খবর আদায় করতে পারছি এই বর্ণলিপিযুক্ত দূরবীন-ফোটােগ্রাফের সাহায্যে। বেগনি-পারের আলো জ্যোতিষীদের কাছে লাল-উজানি আলোর মতো এত বেশি কাজে লাগে না। তার কারণ এই খাটাে ঢেউয়ের আলোর অনেকখানি পৃথিবীর হাওয়া পেরিয়ে আসতে নষ্ট হয়, দূরলোকের খবর দেবার কাজে লাগে না । এরা খবর দেয় পরমাণুলোকের। একটা বিশেষ পরিমাণ উত্তেজনায় পরমাণু সাদা আলোয় স্পাদিত হয়। তেজ আরো বাড়ালে দেখা দেয় বেগনি-পারের আলো । অবশেষে পরমাণুর কেন্দ্রবন্তু যখন বিচলিত হতে থাকে তখন সেই প্ৰবল উত্তেজনায় বের হয় আরো খাটাে ঢেউ যাদের বলি গামা-রশ্মি। মানুষ তার যন্ত্রের শক্তি এতদূর বাড়িয়ে তুলেছে যে একস-রশ্মি বা গামা-রশ্মির মতো রশ্মিকে মানুষ ব্যবহার করতে পারে। যে কথা বলতে যাচ্ছিলুম। সে হচ্ছে এই যে, বর্ণলিপি-বাধা দূরবীন-ফোটােগ্রাফ দিয়ে মানুষ নক্ষত্রবিশ্বের অতি দূর অদৃশ্য লোককে দৃষ্টিপথে এনেছে। আমাদের আপনি নক্ষত্ৰলোকের সুদূর বাইরে