পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৯৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বাংলাভাষা-পরিচয় ¢ዓ@ প্রভৃতি সবকিছু বাদ দিয়ে মানুষ ভাষার একটা কৌশল বিনিয়ে দিলে, বললে তিন-ত্রিকাখে নয়। ও একটা ফাঁদ। তাতে ধরা পড়তে লািগল কেবল গোরু নয় তিন-সংখ্যা-বাধা যে-কোনো তিন জিনিসের পরিমাপ। ভাষা যার নেই। এই সহজ কথাটা ধরে রাখবার উপায় তার হাতে নেই। এই উপলক্ষে একটা ঘটনা আমার মনে পড়ল। ইস্কুলে-পড়া একটা ছোটাে মেয়ের কাছে আমার নামতার অজ্ঞতা প্রমাণ করবার জন্যে পরিহাস করে বলেছিলুম, তিন-পাচে পঁচিশ । চোখদুটাে এত বড়ো করে সে বললে, “আপনি কি জানেন না তিন-পাচে পনেরো ?? আমি বললুম, কেমন করে জানব বলো, সব তিনিই কি এক মাপের । তিনটে হাতিকে পাঁচগুণ করলেও পনেরো, তিনটি টিকটিকিকেও ? শুনে তার মনে বিষম ধিকার উপস্থিত হল, বললে, "তিন যে তিনটে একক, হাতি-টিকটিকির কথা তোলেন কেন।” শুনে আমার আশ্চর্য বোধ হল। যে একক সরুও নয় মোটাও নয়, ভারীও নয়। হালকাও নয়, যে আছে। কেবল ভাষা আঁকড়িয়ে, সেই নিৰ্গুণ একক ওর কাছে এত সহজ হয়ে গেছে যে, আস্ত হাতি-টিকটিকিকেও বাদ দিয়ে ফেলতে তার বাধে না । এই তো ভাষার Q ‘সাদা কথাটাও এইরকম সৃষ্টিছাড়া। সে একটা বিশেষণ, বিশেষ্য। নইলে একবারে নিরর্থক। সাদা বস্তু থেকে তাকে ছাড়িয়ে নিলে জগতে কোথাও তাকে রাখবার জায়গা পাওয়া যায় না, এক ঐ ভাষার শব্দটাকে ছাড়া । এই তো গেল গুণের কথা, এখন বস্তুর কথা । মনে আছে আমার বয়স যখন অল্প আমার একজন মাস্টার বলেছিলেন, এই টেবিলের গুণাগুলি সব বাদ দিলে হয়ে যাবে শূন্য। শুনে মন মানতেই চাইল না। টেবিলের গায়ে যেমন বার্নিশ লাগানো হয় তেমনি টেবিলের সঙ্গে তার গুণগুলো লেগে থাকে, এই রকমের একটা ধারণা বোধ করি আমার মনে ছিল। যেন টেবিলটাকে বাদ দিতে গেলে মুটে ডাকার দরকার, কিন্তু গুণগুলো ধুয়ে মুছে ফেলা সহজ । সেদিন এই কথা নিয়ে স্থা করে অনেকক্ষণ ভেবেছিলুম। অথচ মানুষের ভাষা গুণহীনকে নিয়ে অনেক বড়ো বড়ো কারবার করেছে। একটা দৃষ্টান্ত দিই। আমাদের ভাষায় একটা সরকারি শব্দ আছে, “পদাৰ্থ । বলা বাহুল্য, জগতে পদাৰ্থ বলে কোনো জিনিস নেই ; জল মাটি পাথর লোহা আছে। এমনতরো অনির্দিষ্ট ভাবনাকে মানুষ তার ভাষায় বঁধে কেন । জরুরি দরকার আছে বলেই বাধে । বিজ্ঞানের গোড়াতেই এ কথাটা বলা চাই যে, পদার্থ মাত্রই কিছু-না-কিছু জায়গা জোড়ে। ঐ একটা শব্দ দিয়ে কোটি কোটি শব্দ বাচানো গেল। অভ্যাস হয়ে গেছে বলে এ সৃষ্টির মূল্য ভুলে আছি। কিন্তু ভাষার মধ্যে এই সব অভাবনীয়কে ধরা মানুষের একটা মন্ত কীর্তি । বোঝা-হালকা-করা এই-সব সরকারি শব্দ দিয়ে বিজ্ঞান দর্শন ভরা । সাহিত্যেও তার কমতি নেই । এই মনে করো, “হৃদয়’ শব্দটা বলি অত্যন্ত সহজেই। কারও হৃদয় আছে বা হৃদয় নেই, যত সহজে বলি তত সহজে ব্যাখ্যা করতে পারি নে। কারও মনুষ্যত্ব আছে বলতে কী আছে তা সমস্তটা স্পষ্ট করে বলা অসাধ্য। এ ক্ষেত্রে ধ্বনির প্রতীক না দিয়ে অন্যরকম প্রতীকও দেওয়া যেতে পারে। মনুষ্যত্ব বলে একটা আকারহীন পদার্থকে কোনো-একটা মূর্তি দিয়ে বলাও চলে। কিন্তু মূর্তিতে জায়গা জোড়ে, তাঁর ভার আছে, তাকে বয়ে নিয়ে যেতে হয় । তাছাড়া তাকে বৈচিত্র্য দেওয়া যায় না। শব্দের প্রতীক আমাদের মনের সঙ্গে মিলিয়ে থাকে, অভিজ্ঞতার সঙ্গে সঙ্গে তার অর্থের বিস্তার হতেও বাধা ঘটে না । এ কথাটা জেনে রাখা ভালো যে, এই সব ভার-লাঘব-করা সরকারি অর্থের শব্দগুলিকে ইংরেজিতে বলে অ্যাকট্রিক্ট শব্দ। বাংলায়, এর একটা নতুন প্রতিশব্দের দরকার। বোধ করি নির্বািন্তক' বললে কাজ চলতে পারে । বস্তু থেকে গুণকে নিজান্ত করে নেওয়া যে ভাবমাত্র তাকে বলবার ও বোঝাবার জন্যে নির্বত্তক শব্দটা হয়তো ব্যবহারের যোগ্য। এই অ্যাবস্ট্রাক্ট শব্দগুলোকে আশ্রয় করে মানুষের মন এত মুলুতে পেরেছে যত দূরে তার ইব্রাশক্তি যেতে পারেন, যত দূর তার কােনে যানবাহন