পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৯৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

@ዓዪ9 রবীন্দ্র-রচনাবলী 8 মানুষ যেমন জানিবার জিনিস ভাষা দিয়ে জানায় তেমনি তাকে জানাতে হয় সুখ-দুঃখ, ভালো লগ - মন্দ লােগা, নিন্দা-প্ৰশংসার সংবাদ । ভাবে ভঙ্গীতে, ভাষাহীন আওয়াজে, চাহনিতে, হাসিতে চোখ জলে এই সব অনুভূতির অনেকখানি বোঝানো যেতে পারে। এইগুলি হল মানুষের প্রকৃতিদত্ত বোঝায়। ভাষা, এ ভাষায় মানুষের ভাবপ্রকাশ প্রত্যক্ষ । কিন্তু সুখ দুঃখ ভালোবাসার বোধ অনেক সুহ্মে যায়। উর্ধে যায় ; তখন তাকে ইশারায় আনা যায় না, বর্ণনায় পাওয়া যায় না, কেবল ভাষার নৈপুণে যত দূর সম্ভব নানা ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দেওয়া যেতে পারে। ভাষা হৃদয়বোধের গভীরে নিয়ে যেতে পেরেছে। বলেই মানুষের হৃদয়াবেগের উপলব্ধি উৎকর্ষ লাভ করেছে। সংস্কৃতিমানদের বোধশক্তির রূঢ়তা যায়। ক্ষয় হয়ে, তাদের অনুভূতির মধ্যে সূক্ষ্ম সুকুমার ভারের প্রবেশ ঘটে সহজে। গোয়ার হৃদয় হচ্ছে অশিক্ষিত হৃদয় । অবশ্য স্বভাবদোষে রুচি ও অনুভূতির পরুষতা যাদের মজ্জাগত তাদের আশা ছেড়ে দিতে হয়। জ্ঞানের শক্তি নিয়েও এ কথা খাটে । স্বাভাবিক মূঢ়তা, যাদের দুর্ভেদ্য, জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চায় তাদের বুদ্ধিকে বেশি দূর পর্যন্ত সার্থকতা দিতে পারে না। মানুষের বুদ্ধিসাধনার ভাষা আপন পূর্ণতা দেখিয়েছে দর্শনে বিজ্ঞানে । হৃদয়বৃত্তির চূড়ান্ত প্রকাশ কাব্যে। দুইয়ের ভাষায় অনেক তফাত । জ্ঞানের ভাষা যত দূর সম্ভব পরিষ্কার হওয়া চাই ; তাতে ঠিক কথাটার ঠিক মানে থাকা দরকার, সাজসজ্জার বাহুল্যে সে যেন আচ্ছন্ন না হয় । কিন্তু ভাবের ভাষা কিছু যদি অস্পষ্ট থাকে, যদি সোজা করে না বলা হয়, যদি তাতে অলংকার থাকে উপযুক্তমত, তাতেই কাজ দেয় বেশি। জ্ঞানের চূড়াষায় চাই স্পষ্ট অর্থ ; ভাবের ভাষায় চাই ইশারা, হয়তো অর্থ বাকী কঙ্গে দিয়ে । ভালো লাগা বোঝাতে কবি বললেন, “পাষাণ মিলায়ে যায় গায়ের বাতাসে । বললেন, 'ঢল ঢল। কঁচা অঙ্গের লাবণ অবনি বহিয়া যায় । এখানে কথাগুলোর ঠিক মানে নিলে পাগলামি হয়ে দাড়াবে কথাগুলো যদি বিজ্ঞানের বইয়ে থাকত তা হলে বুঝতুম, বিজ্ঞানী নতুন আবিষ্কার করেছেন এমন একটি দৈহিক হাওয়া যার রাসায়নিক ক্রিয়ায় পাথর কঠিন থাকতে পারে না, গ্যাস রূপে হয় অদৃশ্য ! কিংবা কোনো মানুষের শরীরে এমন একটি রশ্মি পাওয়া গেছে যার নাম দেওয়া হয়েছে। লাবণ, পৃথিবীর টানে যার বিকিরণ মাটির উপর দিয়ে ছড়িয়ে যেতে থাকে । শব্দের অর্থকে একান্ত বিশ্বাস করলে এইরকম একটা ব্যাখ্যা ছাড়া উপায় থাকে না । কিন্তু এ-যে প্রাকৃত ঘটনার কথা নয়, এ-যে মন্মে-হয়-যেন'র কথা । শব্দ তৈরি হয়েছে ঠিকটা-কী জানাবার জন্যে ; সেইজন্যে ঠিক-যেন-কী বলতে গেলে তার অর্থকে বাড়াতে হয়, বাকাতে হয় । ঠিক-যেন-কীর ভাষা অভিধানে বেঁধে দেওয়া নেই, তাই সাধারণ ভাষা দিয়েই কবিকে কৌশলে কাজ চালাতে হয় । তাকেই বলা যায় কবিত্ব । বস্তুত কবিত্ব এত বড়ে জায়গা পেয়েছে তার প্রধান কারণ, ভাষার শব্দ কেবল আপনি সাদা অর্থ দিয়ে সব ভাব প্ৰকাশ করতে পারে না । তাই কবি লাবণ্য শব্দের যথার্থ সংজ্ঞা ত্যাগ করে বানিয়ে বললেন, যেন লাবণ্য একটি ঝরনা, শরীর থেকে ঝরে পড়ে মাটিতে। কথার অর্থটাকে সম্পূৰ্ণ নষ্ট করে দিয়ে এ হল কাকুলতা : এতে বলার সঙ্গে সঙ্গেই বলা হচ্ছে বলতে পারছি নে ; এই অনির্বাচনীয়তার সুযোগ নিয়ে নানা কবি নানারকম অত্যুক্তির চেষ্টা করে । সুযোগ নয় তো কী ; যাকে বলা যায় না। তাকে বলবার সুযোগই কবির সৌভাগ্য। এই সুযোগেই কেউ লাবণ্যকে ফুলের গন্ধের সঙ্গে তুলনা করতে পারে, কেউ ব: নিঃশব্দ বীণাধর্মানির সঙ্গে- অসংগতিকে আরো বহু দূরে টেনে নিয়ে গিয়ে। লাবণ্যকে কবি যে লাবণ বলেছেন সেও একটা অধীরতা। প্রচলিত শব্দকে অপ্রচলিতের চেহারা দিয়ে ভাষার আভিধানিক সীমানাকে অনির্দিষ্ট ভাবে বাড়িয়ে দেওয়া হল । হৃদয়াবেগে যার সীমা পাওয়া যায় না। তাকে প্ৰকাশ করতে গেলে সীমাবদ্ধ ভাষার বেড়া ভেঙে দিতে হয় । কবিত্বে আছে সেই বেড়া ভাঙার কাজ । এইজন্যেই মা তার সন্তানকে যা নয়। তাই বলে এককে আর করে জানায় । বলে চাদ, বলে মানিক, বলে সোনা । এক দিকে ভাষা স্পষ্ট কথার বাহন,