পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬২৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বাংলাভাষা-পরিচয় 90V) তুর চেয়ে আঙুল দেখিয়ে দেয় বেশি। সংস্কৃতে আছে ‘পতনোমুখ, বাংলায় বলে ‘পড়ো-পড়ে। সংস্কৃতে যা আসন্ন বাংলায় তা হব-হব । সেইরকম : গেল-গল যায়-যায়। সংস্কৃতে যা ‘বাম্পাকুল বাংলায় তা ‘কাদো-কাদো । সংস্কৃতে বলে “অবরুদ্ধস্বরে, বাংলায় বলে ‘বাধো-বাধো গলায় । বাংলায় ঐ কথাগুলোতে কেবল যে একটা ভাব পাওয়া যায় তা নয়, যেন ছবি পাই। একটা শ্লোক বলা যাক যাব-যাব করে, চরণ না সূরে, ফিরে-ফিরে চায় পিছে, পড়ো-পড়ো জলে ভরো-ভরা চোখ শুধু চেয়ে থাকে নীচে । ঠিক এরকম একটুকরো রেখালেখ্য এই বাধো-বাধো ভাষাতেই বানানো চলে । বাংলায় বর্ণনার ছবিকে স্পষ্ট করবার জন্যেই এই-যে অস্পষ্ট ভাষার কায়দা, এর কথা বাংলা শব্দতত্ত্ব গ্রন্থে ধ্বন্যাত্মক শব্দের আলোচনায় আরো বিস্তারিত করে বলেছি।” ংলায় কোনো কোনো প্রত্যয় অর্থগত ব্যবহার অতিক্রম করে এইরকম ইঙ্গিতের দিকে পৌচেছে, তার উল্লেখ করা যাক : কিপটমো ছিবলেমো ছেলেমো জ্যাঠামো ঠাট্রামো ফাজলেমো বিটলেমো পেজোমে হাংলামো বোকামো বীদরামো গোড়ামো মাৎলামো গুণ্ডামো । সংস্কৃতের কোন প্রত্যয়ের সঙ্গে এর তুলনা করব ? তু প্রত্যয় দিয়ে 'কিপটমোকে 'কিপটত্ব বলা যেতে পারে। কিন্তু ত্ব প্রত্যয় নির্বিকার, ভালো-মন্দ প্ৰিয়-অপ্ৰিয় জড়-অজড়ে ভেদ করে না। অথচ উপরের ফর্দটা দেখলেই বোঝা যাবে, শব্দগুলো একেবারেই ভদ্রজাতের নয় । গাল-বর্ষণের জনোই যেন পাকের পিণ্ড জমা করা হয়েছে । ঐ টেমা বা আমো প্ৰতায়ের যোগে “বান্দরামো’ বলি, কিন্তু ‘সিংহমো' বলি নে। 'কিপটমো হল, ‘দাতামো হল না। 'পেজোমো’ বলা চলে অনায়াসে, কিন্তু ‘সোধোমে' (সাধুত্ব) বলতে বাধে। একটা প্রত্যয় দিয়ে বিশেষ করে মনের ঝাল মেটাবার উপায় বোধ করি আর-কোনো ভাষাতেই নেই । আর-একটা প্ৰত্যয় দেখো, পনা ; বুড়োপনা নাকাপনা ছিবলেপনা আদুরোপনা গিরিপনা । সবগুলোর মধ্যেই কটাক্ষপাত । ব্যাকরণের প্রত্যয়ের যেরকম ভেদনিবিচার হওয়া উচিত, এ একেবারেই তা নয় । চণ্ডীমণ্ডপে বসে বিরুদ্ধ দলকে খোচা দেবার জন্যেই এগুলো যেন বিশেষ করে en-Ciel আনা প্রত্যয়টা দেখো ; বাবুআনা বিবিআনা সাহেবিআনা নবাবিআনা মুরুব্বি আনা গরিবিআনা । বলা বাহুল্য, এর ভাবখানা, একেবারেই ভালো নয়। ঐ যে “গরিবিআনা শব্দটা বলা হয়েছে, ওর মধ্যেও কপট অহংকারের ভান আছে। যদি বলা যায় সাধু আনা তা হলে বুঝতে হবে সেটা সত্যিকার সাধুত্ব নয় । এই জাতের আর-একটা প্ৰত্যয় আছে, গিরি। তার সঙ্গে প্রায় ফিলাতে কথার যোগ হয় ; বাবুগিরি গুরুগিরি সাধুগিরি দাতাগিরি। এতে ভান করা, মিথ্যে অহংকার করা বোঝায়। আরো একটা প্ৰত্যয় দেখা যাক, অনি বা আনি ; বকুনি ধমকানি ছিচকাদুনি শাসনি ইস্পানি নাকানি-চাবানিজ্বলুনি কঁপুনি মুখ-বাকনি খ্যাকানি লোক-হাসানি ফোপানি গাঙনি ভাঙনি ঘ্যাঙনি খিচুনি ছট্‌ফটানি কুটুকুটুনি ফসফোসনি। এর সবগুলিই গাল-দেওয়া শব্দ নয়, কিন্তু অপ্রিয়। হাসিটা তো ভালো জিনিস, কিন্তু, আনি প্রত্যয় দিয়ে হল ‘লোকহাসানি, হাসির গুণটা গেল বিগড়িয়ে । ইকুনি নিডুনি বিনুনি চাটনি শব্দ বস্তুবাচক, সেইজন্যে তাদের মধ্যে নিন্দার বঁাজ প্রবেশ করতে পারে fo ইআ [বিকারে ‘এ’ ] প্ৰত্যয়টা যখন বস্তুসূচক না হয়ে ভাবসূচক হয়, তখন তার ইঙ্গিতে কোথাও সুখের বা শ্ৰদ্ধার আভাস পাব না। যেমন : নড়বড়ে নিড়বড়ে খিটখিটৌ কটমটে টনটনে কনকনে ১। রবীন্দ্র-রচনাকালী। স্বাদশ খণ্ড,প ৩৭৪(সুলভ ৬, পৃ. ৬২৮)} . . . TA NA