পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৬৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পথের সঞ্চয় লোককে ঠিক ব্যবস্থামতে চালনা করা এবং তাঁহাদের পেট ভরাইয়া দেওয়া আমাদের শক্তির অতীত । এইজন্য কাজের চেয়ে কাজের উৎপাত অনেকগুণ বেশি হইয়া উঠে, আয়োজনের চেয়ে আবর্জনই বাড়ে এবং তরুণীতে ছিদ্র ক্রমে এত দেখা দেয় যে দাঁড় টানার চেয়ে জল-হেঁচাতেই বেশি শক্তি ব্যয় করিতে হয়- আমাদের দেশে যে-কেহ যে-কোনো কাজে হাত দিয়াছে তাহাকে এ কথা স্বীকার করিতেই হইবে । আমি সেই ইঞ্জিনিয়ারটিকে বলিলাম, "তোমাদের দেশে যৌথ কারবার ও কলকারখানায় গুণেই কি জিনিসের মূল্য কম হইতেছে না।’ তিনি বলিলেন, তাহা হইতে পারে, কিন্তু কোনো দেশে যৌথ কারবার আগে এবং উন্নতি তাহার পরে, এমন কথা বলা যায় না। মানুষ যখন যৌথ কারবারে মিলিবার উপযুক্ত হয় তখনই যৌথ কারবার আপনিই ঘটিয়া উঠে । তিনি কহিলেন, “আমি মাদ্রাজের দিকে দক্ষিণ ভারতে অনেক দেশীয় যৌথ কারবারের উৎপত্তি ও বিলুপ্ত দেখিয়াছি । দেখিতে পাই, অনুষ্ঠানটার প্রতি যে লায়ালটি অর্থাৎ যে নিষ্ঠা ও শ্রদ্ধার প্রয়োজন তাহা কাহারও নাই, প্রত্যেকে স্বতন্ত্রভাবে নিজের দিকে তাকায় । ইহাতে কখনোই কোনো জিনিস বধিতে পারে না। এই দৃঢ়নিষ্ঠ প্রাণপণ লয়ালটি যদি জাতীয় চরিত্রের মধ্যে সঞ্চারিত হয় তবে সমস্ত সম্মিলিত শুভানুষ্ঠান সম্ভবপর छ् ।।' কথাটা আমার মনে লাগিল । অনুষ্ঠানের দ্বারা মঙ্গলসাধন করা যায়, এ কথাটা সত্য নহে-- গোড়াতেই মানুষ আছে। আমাদের দেশে একজন মানুষকে আশ্রয় করিয়া এক-একটা কাজ জাগিয়া উঠে ; তাহার পরে সেই কাজকে যাহারা গ্ৰহণ করে তাহারা তাহাকে যতটা আশ্রয় করে ততটা আশ্রয় দেয় না । কারণ, তাহার কাজের দিকে তেমন করিয়া তাকায় না। যেমন করিয়া নিজের দিকে তাকায় । কথায় কথায় তাহাদের মুষ্টি শিথিল হইয়া পড়ে, বাধাকে তাহারা অতিক্রমের চেষ্টা না করিয়া বাধাকে ত্যাগ করিয়া পালাইতে চায়, এবং কেবলই মনে করিতে থাকে, ইহার চেয়ে আর কোনোরূপ অবস্থা হইলে ইহার চেয়ে আরো ভালো ফল পাওয়া যাইত । এমনি করিয়া তাহারা বিচ্ছিন্ন হইয়া যায়একটা হইতে পাঁচ টুকরা দাঁড়ায় এবং পাঁচটাই ব্যর্থ হয়। ভালোমন্দ বাধাবিপত্তি সমস্তটাকে বীরের মতো স্বীকার করিয়া আরদ্ধ কর্মকে একান্ত লয়ালটির সঙ্গে শেষ পর্যন্ত বহন করিবার অধ্যবসায় যতদিন আমাদের সাধারণের চিত্তে না জাগিবে ততদিন সম্মিলিত হিতানুষ্ঠান ও যৌথ বাণিজ্য আমাদের দেশে একেবারে অসম্ভব হইবে । এই লয়ালটি, ইহা বুদ্ধিগত নহে, ইহা হৃদয়গত, জীবনগত । সমস্ত অপূর্ণতার ভিতর দিয়া মানুষ নিজেকে কিসের জোরে বহন করে। একটা জীবনের গভীর আকর্ষণে । লাভ-লোকসানের সমস্ত হিসাব সেই জীবনের টানের কাছে লঘু। এমনটা যদি না হইত। তবে কথায় কথায় সামান্য কারণে, সামান্য ক্ষতিতে, সামান্য অসন্তোষে, মানুষ আত্মহত্যা করিয়া নিষ্কৃতি লইত । সেইরূপ যে কর্মে আমরা জীবনকে নিয়োগ করিয়াছি তাহার প্রতি যদি আমাদের জীবনগত নিষ্ঠ না থাকে, তাহার প্রতি যদি আমাদের একটা বেহিসাবি আকর্ষণ না থাকে, তাহার প্রতি অপরাহত শ্ৰদ্ধা লইয়া আমরা যদি পরাভাবের দলেও দাড়াইতে না পারি, যদি মৃত্যুর মুখেও তাহার জয়পতাকাকে সর্বোচ্চ তুলিয়া ধরিবার বল না পাই, যদি অভিমনুর মতো বৃহের মধ্য হইতে বাহির হইবার বিদ্যাটাকে আমরা একেবারে অগ্রাহ্য না করি, তাহা হইলে আমরা কিছুই সৃষ্টি করিতে পারিব না, রক্ষা করিতেও পারিব না। ইহা আমাদের, অতএব ইহা আমারই এই কথাটাকে শেয় পর্যন্ত সমস্ত লাভক্ষতি, সমস্ত হারজিতের মধ্যে প্রাণপণে বলিবার শক্তি সর্বাগ্রে আমাদের চাই ; তাহার পরে যে-কোনো অনুষ্ঠানকেই আশ্রয় করি।-না কেন, একদিন না একদিন বিয়াসমুদ্র পার হইতে পারিব । নিরতিশয় কর্মের প্রয়াসের দ্বারা য়ুরোপের জীবন জীর্ণ হইতেছে, এই কথাটা আজকাল পশ্চিমদেশেও শোনা যায় এবং এই কথাটা একেবারে মিথ্যাও নহে। আমি পূর্বেই বলিয়াছি, য়ুরোপ কোনো অভাব কোনো অসুবিধাকেই কিছুমাত্র মানিবে না, এই তাহার পণ। নিজের শক্তির উপরে তাহার অক্ষুদ্র বিশ্বাস। সেই বিশ্বাস থাকাতেই তাহার শক্তি পূর্ণ গীেরবে কাজ করিতেছে এবং অসাধ্য