পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৯২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Vs A রবীন্দ্র-রচনাবলী প্রয়োজনীয় কাজের চারি দিকে একটা মুক্তির ক্ষেত্রেই মানুষের ঐশ্বৰ্য । এ দেশে যাহারা খ্যাতিলাভ করিয়াছেন তাহাদের অনেকের মধ্যেই সেইটে লক্ষ্য করি। তঁহারা যেটা লইয়া প্রধানত নিযুক্ত আছেন সেইটোতেই তাহদের জীবনের সমন্ত জায়গা একেবারে ঠাসিয়া ধরে নাই ; চারিদিকে খানিকটা ফাকা জায়গা আছে, সেইখানে তঁহাদের বিহার। খুব বড়ো বৈজ্ঞানিককে দেখিয়াছি, তঁহার প্রধান শখ চীনদেশের চিত্ৰকলা । ইহাদের জীবনের তহবিলে বাড়তির ভাগ অনেকটা থাকে । ব্যবসায় ইহাদের অনেকের পক্ষেই একটা অংশমাত্র । আপিসম্বর ইহাদের বাসগৃহের একটামাত্র ঘর । অনেক সিঁড়ি ভাঙিয়া উপরের তলায় একটি ছোটােকামরায় ইহার সঙ্গে দেখা হইল। অনেকক্ষণ আমাদের দুইজনের নিতৃত আলাপের অবকাশ ঘটিয়াছিল। তঁহার কথাবার্তা হইতে আমি এইট বুঝিলাম যে, খৃস্টানধর্মের বাহ্য কাঠামো, যেটাকে ইংরেজি ভাষায় বলে creed. কোনোকালে তাহার যেমনই প্রয়োজন থাক, এখন তাহাতে ধর্মের বিশুদ্ধ রাসপ্রবাহের বাধা ঘটাইতেছে। মানুষের মন যখনই আপনার আশ্রয়কে ছাড়াইয়া বাড়িয়া উঠে তখনই সেই আশ্রয়ের মতো শক্ৰ তাহার আর কেহ নাই। এ দেশে ধর্মের প্রতি অনেকের মন যে বিমুখ হইয়াছে তাহার প্রধান কারণ, ধর্মের এই বাহিরের আয়তনটা । তিনি আমাকে বলিলেন, “তোমার এই কবিতাগুলিতে কোনো ধর্মের কোনো creed-এর কোনো গন্ধ নাই ; ইহাতে এগুলি আমাদের দেশের লোকের বিশেষ উপকারে লাগিবে বলিয়া আমি মনে করি ।” কথায় কথায় তিনি এক সময়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, আমি জন্মান্তরে বিশ্বাস করি কি না ; নাই এবং সে সম্বন্ধে আমি চিন্তা করা আবশ্যক মনে করি না । কিন্তু, যখন চিন্তা করিয়া দেখি তখন মনে হয়, ইহা কখনো হইতেই পারে না যে, আমার জীবনধারার মাঝখানে এই মানবজন্মটা একেবারেই খাপছাড়া জিনিস- ইহার আগেও এমন কখনো ছিল না, ইহার পরেও এমন কখনো হইবে না, যে কারণ-বশত জীবনটা বিশেষ দেহ হইয়া প্ৰকাশ পাইয়াছে সে কারণটা এই জন্মের মধ্যেই প্ৰথম আরম্ভ হইয়া এই জন্মের মধ্যেই সম্পূর্ণ শেষ হইয়া গেল। শরীরী জন্ম পুনঃ পুনঃ প্রকাশিত হইতে হইতে আপনাকে পূর্ণতর করিয়া তুলিতেছে, এইটেই সম্ভবপর বলিয়া বোধ হয়। কিন্তু, পূর্বজন্মে কোনো মানুষ পশু ছিল এবং পরজন্মেই সে পশুদেহ ধরিবে এ কথাও আমি মনে করিতে পারি না। কেননা, প্রকৃতির মধ্যে একটা অভ্যাসের ধারা দেখা যায়, সেই ধারার হঠাৎ অত্যন্ত বিচ্ছেদ ঘটা অসংগত । স্টপফোর্ড বুক বলিলেন, তিনিও জন্মান্তরে বিশ্বাসটাকে সংগত মনে করেন। তাহার বিশ্বাস, নানা জন্মের মধ্য দিয় যখন আমরা একটা জীবনচক্ৰ সমাপ্ত করিব, তখন আমাদের পূর্বজন্মের সমস্ত স্মৃতি সম্পূর্ণ হইয়া জাগ্রত হইবে। এ কথাটা আমার মনে লাগিল। আমার মনে হইল, একটা কবিতা পড়া যখন আমরা শেষ করিয়া ফেলি। তখনই তাহার সমন্তর ভাবটা পরম্পরাগ্রথিত হইয়া আমাদের মনে উদিত হয় ; শেষ না করিলে সকল সময় সেই সূত্রটি পাওয়া যায় না। আমরা প্ৰত্যেকে একটা অভিপ্ৰায়কে অবলম্বন করিয়া এক-একটা জন্মমালা গাথিয়া চলিয়াছি ; গাথা শেষ হইলেই যে একেবারেই ফুরাইয়া যায় তাহা নহে, কিন্তু একটা পালা শেষ হইয়া যায়। তখনই সমস্তটাকে স্পষ্ট করিয়া গ্ৰহণ করিতে পারি। এখানকার যে-সকল চিন্তাশীল ও ভাবুক লোকদের সঙ্গে আমার আলাপ হইয়াছে সকলেরই মধ্যে একটা জিনিস। আমি লক্ষ্য করিয়াছি, তাহারা অন্যায় ও অবিচারকে সত্যই ঠেলিয়া ফেলিতে চান । এ কথা বলা বাহুল্য মনে হইতে পারে, কিন্তু বাহুল্য নহে। যে জাতি বহুদূরবিস্তৃত অধীন দেশকে শাসন করে এবং সেইসকল অধীন দেশের সহিত যাহাদের নানাবিধ স্বার্থের সম্বন্ধ জড়িত, পরজাতির সম্বন্ধে তাহাদের ন্যায়-অন্যায়ের বোধস্নান না হইয়া থাকিতে পারে না। অন্য জাতিকে যতদিনসম্ভব অধীনস্থ করিয়া রাখা নানা কারণে যাহার নিজের পক্ষে প্রয়োজনীয়, মানবন্বাধীনতা সম্বন্ধে তাহার ধর্মবোধ কখনোই অক্ষুধা থাকে না। যে শুভবুদ্ধি-স্বারা মানুষ স্বজাতির স্বাধীনতাকে শ্রেষ্ঠ মূল্য দিয়া থাকে, অন্যকে অধীন রাখিবার ইচ্ছা যতই প্রবল হয় ততই সেই শুভবুদ্ধিকেই মানুষ দুর্বল করিয়া ফেলে।