পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭০৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

१५ अर्थ ve হার্মািন অতিমাত্র প্রবল হইলে গীতটিকে আচ্ছন্ন করিয়া ফেলে, এবং গীত যেখানে অত্যন্ত স্বতন্ত্র হইয়া উঠিতে চায় সেখানে হার্মািনকে কাছে আসিতে দেয় না। উভয়ের মধ্যে এই বিচ্ছেদটা কিছুদিন পর্যন্ত ভালো। প্রত্যেকের পূর্ণপরিণত রূপটিকে পাইবার জন্য কিছুকাল প্রত্যেকটিকে স্বাতন্ত্র্যের অবকাশ দেওয়াই উচিত। কিন্তু, তাই বলিয়া চিরকালই তাহদের আইবুড় থাকাটাকে শ্রেয় বলিতে পারি না। বর ও কন্যা যতদিন যৌবনের পূর্ণতা না পায় ততদিন তাহাদের পৃথক হইয়া বাড়িতে দেওয়াই ভালো, কিন্তু তার পরেও যদি তাহারা মিলিতে না পারে তবে তাহারা অসম্পূর্ণ হইয়া থাকে। গীত ও হার্মািনর যে মিলিবার দিন আসিয়াছে তাহাতে কোনো সন্দেহ নাই। সেই মিলনের আয়োজনও শুরু হইয়াছে । গ্রামে হস্তায় বিশেষ একদিন হাট বসে, বৎসরে বিশেষ একদিন মেলা হয় । সেইদিন পরম্পরের পণ্যবিনিময় করিয়া মানুষের যাহার যাহা অভাব আছে তাহা মিটাইয়া লয়। মানুষের ইতিহাসেও তেমনি এক-একটা যুগে হাটের দিন আসে ; সেদিন যে যার আপনি আপনি সামগ্ৰী বুড়িতে করিয়া আনিয়া পরের সামগ্ৰী সংগ্ৰহ করিতে আসে। সেদিন মানুষ বুঝিতে পারে, একমাত্র নিজের উৎপন্ন জিনিসে মানুষের দৈন্য দূর হয় না ; বুঝিতে পারে, নিজের ঐশ্বর্যের একমাত্র সার্থকতা এই যে, তাহাতে পরের জিনিস পাইবার অধিকার জন্মে। এইরূপ যুগকে যুরোপের ইতিহাসে রেনেসঁসের যুগ বলিয়া থাকে। পৃথিবীতে বর্তমান যুগে যে রেনেসঁসের হাট বসিয়া গেছে। এতবড়ো হাট ইহার আগে আর-কোনোদিন বসে নাই। তাহার প্রধান কারণ, আজ পৃথিবীতে চারি দিকের রাস্তা যেমন খোলসা হইয়াছে এমন আর-কোনোদিন ছিল না । কিছুদিন পূর্বে একজন মনীষী আমাকে বলিয়াছিলেন, য়ুরোপে ভারতববীয় রেনেসঁসের একটা কাল আসন্ন হইয়াছে ভারতবর্ষের ঐতিহাসিক ভাণ্ডারে যে সম্পদ সঞ্চিত আছে হঠাৎ তাহা য়ুরোপের নজরে পড়িতেছে এবং যুরোপ অনুভব করিতেছে, সেগুলিতে তাহার প্রয়োজন আছে। এতদিন ভারতবর্ষের চিত্রশিল্প ও স্থাপত্য যুরোপের অবজ্ঞাভাজন হইয়াছিল ; এখন তাহার বিশেষ একটি মহিমা য়ুরোপ দেখিতে পাইয়াছে। অতি অল্পকাল হইল। ভারতবষীয় সংগীতের উপরও য়ুরোপের দৃষ্টি পড়িয়াছে। আমি ভারতবর্ষে থাকিতেই দেখিয়াছি, য়ুরোপীয় শ্রোতা তন্ময় হইয়া সুরবাহারে বাগেশ্ৰী রাগিণীর আলাপ শুনিতেছেন। একদিন দেখিলাম, একজন ইংরেজ শ্রোতা একটি সভায় বসিয়া দুইজন বাঙালি যুবকের নিকট সামৰেদের গান শুনিতেছেন । গায়ক দুইজন বেদমন্ত্রে ইমনকল্যাণ ভৈরবী প্রভৃতি বৈঠকি সুর যোগ করিয়া তঁহাকে সামগান বলিয়া শুনাইতেছেন। তঁহাকে আমার বলিতে হইল, এ জিনিসটাকে সামগন । বলিয়া গ্ৰহণ করা চলিবে না। দেখিলাম, তাহাকে সতর্ক করিয়া দেওয়া আমার পক্ষে নিতান্ত বাহুল্য ; অল্প যেটুকু জানি সেই অনুসারে আবৃত্তি করিলাম। তখনই তিনি বলিলেন, এ তো যজুর্বোেদর আবৃত্তির প্ৰণালী । বস্তুত আমি যজুর্বোেদর মন্ত্রই আবৃত্তি করিয়াছিলাম। বেদগান হইতে আরম্ভ করিয়া ধ্ৰুপদ-খেয়ালের রাগ মান লয় তিনি তন্ন তন্ন করিয়া সন্ধান করিয়াছেন- ‘তাঁহাকে সহজে ফাকি দিবার জো নাই। ইনি ভারতবষীয় সংগীত সম্বন্ধে বই লিখিতেছেন । শ্ৰীমতী মডুমেকার্থির লেখা মডারুন-রিভিয়ু পত্রিকায় মাঝে মাঝে বাহির হইয়াছে। শিশুকাল হইতেই সংগীতে ইহার অসামান্য প্রতিভা । নয়। বৎসর বয়স হইতেই ইনি প্রকাশ্য সভায় বেহালা বাজাইয়া শ্রোতাদিগকে বিস্মিত করিয়াছেন । দুৰ্ভাগ্যক্রমে ইহার হাতে স্নায়ুঘটিত পীড়া হওয়াতে ইহার বাজনা বন্ধ হইয়া গিয়াছে। ইনি ভারতবর্ষে থাকিয়া কিছুকাল বিশেষ ভাবে দক্ষিণভারতের সংগীত আলোচনা করিয়াছেন ; ইনিও সে সম্বন্ধে বই লিখিতে প্ৰবৃত্ত আছেন। একদিন ডাক্তার কুমারস্বামীর এক নিমন্ত্রণাপত্রে পড়িলাম, তিনি আমাকে রতন দেবীর গান শুনাইবেন। রতন দেবী কে বুঝিতে পারিলাম না ; ভাবিলাম কোনো ভারতববীয় মহিলা হইবেন। দেখিলাম। তিনি ইংরেজ মেয়ে, যেখানে নিমন্ত্রিত হইয়াছি সেইখানকার তিনি গৃহস্বামিনী ।