পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭১৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ዋሺ88 3ዝቑቛ রাখিয়া শিক্ষার ব্যবস্থা বিচিত্র আকারে আপনিই আপনাকে সৃষ্টি করিয়া তুলিতেছিল। কারণ, সৃষ্টির নিয়মই তাই ; একটা মূল ভাবের বীজ জীবনের তাগিদে স্বতই আপন শাখা-প্ৰশাখা বিস্তার করিয়া বাড়িয়া ওঠে, বাহির হইতে কেহ ডালপালা সংগ্ৰহ করিয়া আনিয়া জুড়িয়া দেয় না। আমাদের বর্তমান সমাজের কোনো সজীব দাবি নাই- এখনো সে মানুষকে বলিতেছে, "ব্ৰাহ্মণ হও, শূদ্র হও।” যাহা বলিতেছে তাহা সত্যভাবে পালন করা কোনোমতেই সম্ভবপর নহে, সুতরাং মানুষ তাহাকে কেবলমাত্র বাহিরের দিক হইতে মানিয়া লইতেছে। ব্ৰাহ্মণ হইবার কালে ব্ৰহ্মচর্য নাই ; মাথা মুড়াইয়া তিন দিনের প্ৰহসন-অভিনয়ের পর গলায় সূত্ৰধারণ আছে। তপস্যার দ্বারা পবিত্র জীবনের শিক্ষা ব্ৰাহ্মণ এখন আর দান করিতে পারে না, কিন্তু পদধূলিদানের বেলায় সে অসংকোচে মুক্তপদ। এদিকে জাতিভেদের মূল প্রতিষ্ঠা বৃত্তিভেদ একেবারেই ঘুচিয়া গেছে এবং তাঁহাকে রক্ষা করাও সম্পূর্ণ অসম্ভব হইয়াছে, অথচ বৰ্ণভেদের বাহ্য বিধিনিষেধ সমস্তই অচল হইয়া বসিয়া আছে। খাচাটাকে তাহার সমস্ত লোহর শিক ও শিকলি-সমেত মানিতেই হইবে, অথচ পাখিটা মরিয়া গেছে। দানাপানি নিয়ত জোগাইতেছে অথচ তাহা কোনো প্রাণীর খোরাকে লাগিতেছে না। এমনি করিয়া আমাদের সামাজিক জীবনের সঙ্গে সামাজিক বিধির বিচ্ছেদ ঘটিয়া যাওয়াতে আমরা কেবল যে অনাবশ্যক কালবিরোধী ব্যবস্থার দ্বারা বাধাগ্ৰস্ত হইয়া আছি তাহা নহে, আমরা সামাজিক সত্যুরক্ষা করিতে পারিতেছে না। আমরা মূল্য দিতেছি ও লইতেছি, অথচ তাহার পরিবর্তে কোনো সত্যবন্তু নাই। শিষ্য গুরুকে প্ৰণাম করিয়া দক্ষিণা চুকাইয়া দিতেছে, কিন্তু গুরু শিষ্যকে শুরুর দেনা শোধ করিবার চেষ্টামাত্র করিতেছে না ; এবং গুরু পুরাকালের বিস্মৃত ভাষায় শিষ্যকে উপদেশ দিতেছে, শিষ্যের তাহা গ্ৰহণ করিবার মতো শ্রদ্ধাও নাই, সাধ্যও নাই, ইচ্ছাও নাই । ইহার ফল হইতেছে এই সত্যবস্তুর যে কোনো প্রয়োজন আছে। এই বিশ্বাসটাই আমরা ক্ৰমশ হরাইতেছি। এই কথা স্বীকার করিতে আমরা লেশমাত্র লজ্জাও বোধ করিনা যে, বাহিরের ঠাট বজায় রাখিয়া গেলেই যথেষ্ট । এমন-কি, এ কথা বলিতেও আমাদের বাধে না যে, ব্যবহারত যথেচ্ছাচার করে। কিন্তু প্ৰকাশ্যত তাহা কবুল না করিলে কোনো ক্ষতি নাই। এমনতরো মিথ্যাচার মানুষকে দায়ে পড়িয়া অবলম্বন করিতে হয় । কারণ, যখন তোমার শ্রদ্ধা অন্য পথে গিয়াছে তখনো সমাজ যদি কঠোর শাসনে আচারকে একই জায়গায় বাধিয়া রাখে, তাহা হইলে সমাজের পনেরো-আনা লোক মিথ্যাচারকে অবলম্বন করিতে লজ্জা বোধ কুরে না। কারণ, মানুষের মধ্যে বীরপুরুষের সংখ্যা অল্প, অতএব সত্যকে প্রকাশ্যে স্বীকার করিবার দণ্ড যেখানে অসহ্যরূপে অতিমাত্র সেখানে কপটতাকে অপরাধ করিয়া গণ্য করা আর চলে না । এইজন্য আমাদের দেশে এই একটা অদ্ভুত ব্যাপার প্রত্যহই দেখা যায়, মানুষ একটা জিনিসকে ভালো বলিয়া স্বীকার করিতে অনায়াসে পারে অথচ সেই মুহুর্তেই অমানবদনে বলিতে পারে যে সামাজিক ব্যবহার ইহা আমি পালন করিতে পারিব না । আমরাও এই মিথ্যাচারকে ক্ষমা করি যখন চিন্তা করিয়া দেখি, এ সমাজে নিজের সত্য বিশ্বাসকে কাজে খাটাইবার মাশুল কত অসাধ্যরূপে অতিরিক্ত । অতএব, সমাজ যেখানে জীবনপ্রাহের সহিত আপন স্বাস্থ্যকর সামঞ্জস্যের পথ একেবারেই খোলা রাখে নাই, সুতরাং পুরাতনকালের ব্যবস্থা যেখানে পদে পদে বাধাস্বরূপ হইয়া তাহাকে বদ্ধ করিয়া তুলিতেছে, সেখানে মানুষের যে শিক্ষাশালা সকলের চেয়ে স্বাভাবিক ও প্রশস্ত সেটা যে আমাদের পক্ষে নাই তাঁহা নহে ; তাহা তদপেক্ষা ভয়ংকর, তাহা আছে। অথচ নাই, তাহা সত্যকে পথ ছাড়িয়া দেয় না এবং মিথ্যাকে জমাইয়া রাখে। এ সমাজ গতিকে একেবারেই স্বীকার করিতে চায় না বলিয়া স্থিতিকে কলুষিত করিয়া তোলে। সামাজিক বিদ্যালয়ের তো এই বন্ধ দশা, তাহার পরে রাজকীয় বিদ্যালয়। সেও একটা প্ৰকাণ্ড ছাঁচে-ঢালা ব্যাপার। দেশের সমস্ত শিক্ষাবিধিকে সে এক ছাচে শক্ত করিয়া জমাইয়া দিবে, ইহাই তাহার একমাত্র চেষ্টা । পাছে দেশ আপনার স্বতন্ত্র প্রণালী আপনি উদ্ভাবিত করিতে চায়, ইহাই তাহার সবচেয়ে ভয়ের বিষয়। দেশের মনঃপ্রকৃতিতে একাধিপত্য বিস্তার করিয়া সে আপনার আইন খাটাইবে, ইহাই তাহার মতলব । সুতরাং এই বৃহৎ বিদ্যার কল কেরানিগিরির কাল হইয়া উঠিতেছে।