পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭২০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Պoo রবীন্দ্র-রচনাবলী লোকসংখ্যার কোনো মূল্য নাই- কিন্তু, সমাজে যতগুলি লোক আছে তাহদের অধিকাংশের যথাসম্ভব শক্তিসম্পদ কাজে খাটিতেছে, মাটিতে পোতা নাই, ইহাই সমৃদ্ধি। শক্তি যেখানে গতিশীল হইয়া আছে সেইখানেই মঙ্গল, ধন যেখানে সজীব হইয়া খাটিতেছে সেইখানেই ঐশ্বৰ্য । এই পাশ্চাত্যদেশে লক্ষ্যবোধের আহবান সকলেই শুনিতে পাইয়াছে ; মোটের উপর সকলেই জানে সে কী চায় ; এইজন্য সকলেই আপনার ধনুক বাণ লইয়া প্ৰস্তুত হইয়া আসিয়াছে। যজ্ঞসম্ভবা যজ্ঞসেনীকে পাইবে, এই আশায় যে বহু উচ্চে বুলিতেছে তাহাকে বিদ্ধ করিতে সকলেই পাণ করিয়াছে। এই লক্ষ্যবোধের নিমন্ত্রণ আমরা পাই নাই । এইজন্য কী পাইতে হইবে সে বিষয়ে অধিক চিন্তা করা আমাদের পক্ষে অনাবশ্যক এবং কোথায় যাইতে হইবে তাহাও আমাদের সম্মুখে স্পষ্ট रुझाि निष्ट्रि नाश् । এইজনা যখন এমনতরো প্রশ্ন শুনি “আমরা কী শিখিব- কেমন করিয়া শিখিব- শিক্ষার কোন প্ৰণালীর কোথায় কী ভাবে কাজ করিতেছে- তখন আমার এই কথা মনে হয়, শিক্ষা জিনিসটা তো জীবনের সঙ্গে সংগতিহীন একটা কৃত্রিম জিনিস নহে। আমরা কী হইব এবং আমরা কী শিখিব, এই দুটা কথা একেবারে গায়ে গায়ে সংলগ্ন । পাত্ৰ যত বড়ো জল তাহার চেয়ে বেশি ধরে না। চাহিবার জিনিস আমাদের বেশি কিছু নাই ! সমাজ আমাদিগকে কোনো বড়ো ডাক ডাকিতেছে না, কোনো বড়ো ত্যাগে টানিতেছে না- ওঠা-বসা খাওয়া-ছোওয়ার কতকগুলা কৃত্রিম নিরর্থক নিয়মপালন ছাড়া আমাদের কাছ হইতে সে আর-কোনো বিষয়ে কোনো কৈফিয়ত চায় না । রাজশক্তিও আমাদের জীবনের সম্মুখে কোনো বৃহৎ সঞ্চরণের ক্ষেত্র অবারিত করিয়া দেয় নাই ; সেখানকার কাটার বেড়াটুকুর মধ্যে আমরা যেটুকু আশা করিতে পারি তাহা নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর, এবং সেই বেড়ার ছিদ্ৰ দিয়া আমরা যেটুকু দেখিতে পাই তাহাও অতি যৎসামান্য । জীবনের ক্ষেত্ৰকে বড়ো করিয়া দেখিতে পাই না বলিয়াই জীবনকে বড়ো করিয়া তোলা এবং বড়ো করিয়া উৎসর্গ করিবার কথা আমাদের স্বভাবত মনেই আসে না । সে সম্বন্ধে যেটুকু চিন্তা করিতে যাই তাহা পুঁথিগত চিন্তা, যেটুকু কাজ করিতে যাই সেটুকু অন্যের অনুকরণ। আমাদের আরো বিপদ এই যে, যাহারা আমাদের খাচার দরজা এক মুহুর্তের জন্য খুলিয়া দেয় না। তাহারাই রাত্রিদিন বলে, “তোমাদের উড়িবার শক্তি নাই।’ পাখির ছানা তো বি. এ. পাস করিয়া উড়িতে শেখে না ; উড়িতে পায় বলিয়াই উড়িতে শেখে। সে তাহার স্বজনসমাজের সকলকেই উড়িতে দেখে ; সে নিশ্চয় জানে, তাহাকে উড়িতেই হইবে । উড়িতে পারা যে সম্ভব, এ সম্বন্ধে কোনোদিন তাহার মনে সন্দেহ আসিয়া তাহাকে দুর্বল করিয়া দেয় না। আমাদের দুর্ভাগ্য এই যে, অপরে আমাদের শক্তি সম্বন্ধে সর্বদা সন্দেহ প্ৰকাশ করে বলিয়াই, এবং সেই সন্দেহকে মিথ্যা প্ৰমাণ করিবার কোনো ক্ষেত্ৰ পাই না বলিয়াই, অন্তরে অন্তরে নিজের সম্বন্ধেও একটা সন্দেহ বদ্ধমূল হইয়া যায়। এমনি করিয়া আপনার প্রতি যে লোক বিশ্বাস হারায় সে কোনো বড়ো নদী পাড়ি দিবার চেষ্টা পর্যন্তও করিতে পারে না ; অতি ক্ষুদ্র সীমানার মধ্যে ডাঙার কাছে কাছে সে ঘূরিয়া বেড়ায় এবং তাঁহাতেই সে সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট থাকে এবং যেদিন সে কোনো গতিকে বাগবাজার হইতে বরানগর পর্যন্ত উজান ঠেলিয়া যাইতে পারে সেদিন সে মনে করে, “আমি অবিকল কলম্বসের সমতুল্য কীর্তি করিয়াছি।” তুমি কেরানির চেয়ে বড়ো, ডেপুটি-মুসেফের চেয়ে বড়ো, তুমি যাহা শিক্ষা করিতেছ। তাহ হাউইয়ের মতো কোনোক্রমে ইস্কুল-মাস্টারি পর্যন্ত উড়িয়া তাহার পর পেন্সনভোগী জরাজীর্ণতার মধ্যে ছাই হইয়া মাটিতে আসিয়া পড়িবার জন্য নহে, এই মন্ত্রটি জপ করিতে দেওয়ার শিক্ষাই আমাদের দেশে সকলের চেয়ে প্রয়োজনীয় শিক্ষা- এই কথাটা আমাদের নিশিদিন মনে রাখিতে হইবে । এইটে বুঝিতে না পারার মুঢ়তাই আমাদের সকলের চেয়ে বড়ো মূঢ়তা । “আমাদের সমাজে এ কথা আমাদিগকে বোঝায় না, আমাদের ইস্কুলেও এ শিক্ষা নাই । কিন্তু, যদি কেহ মনে করেন তবে বুঝি দেশের সম্বন্ধে আমি হতাশ হইয়া পড়িয়াছি, তবে তিনি ভুল বুঝিবেন। আমরা কোথায় আছি, কোন দিকে চলিতেছি, তাহা সুস্পষ্ট করিয়া জানা চাই। সে জানাটা