পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৪২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

S8 রবীন্দ্র-রচনাবলী সবটাই ক্যাপিটল অক্ষর। পড়তে পড়তে ঢুলি, ঢুলতে ঢুলতে চমকে উঠি। যত পড়ি তার চেয়ে না। পড়ি অনেক বেশি।-- বিছানায় ঢুকে এতক্ষণ পরে পাওয়া যায় একটুখানি পোড়ো সময় । সেখানে শুনতে শুনতে শেষ হতে পায় না- রাজপুত্ত্বর চলেছে তেপান্তর মাঠে । তখনকার কালের সঙ্গে এখনকার কালের তফাত ঘটেছে। এ কথা স্পষ্ট বুঝতে পারি যখন দেখতে পাই আজকাল বাড়ির ছাদে না আছে মানুষের আনাগোনা, না আছে ভূতপ্রেত্যের। পূর্বেই জানিয়েছি, অত্যন্ত বেশি লেখাপড়ার আবহাওয়ায় টিকতে না পেরে ব্ৰহ্মদৈত্য দিয়েছে দীেড়। ছাদের কানিসে তার আরামে পা রাখবার গুজব উঠে গিয়ে সেখানে ঐঠে আমের আঁঠি নিয়ে কাকেদের চলেছে ছেড়াছড়ি। এদিকে মানুষের বসতি আটক পড়েছে নীচের তলায় চোরকোনা দেয়ালের প্যাকবাজে। মনে পড়ে বাড়ি-ভিতরের পাচিল-ঘেরা ছাদ । মা বসেছেন সন্ধেবেলায় মাদুর পেতে, তার সঙ্গিনীরা চার দিকে ঘিরে বসে গল্প করছে । সেই গল্পে খাটি খবরের দরকার ছিল না । দরকার কেবল সময়-কাটানো । তখনকার দিনের সময় ভর্তি করবার জন্যে নানা দামের নানা মালমসলার বরাদ ছিল না। দিন ছিল না। ঠাসবুনুনি করা, ছিল বড়ো-বড়ো-ফ্যাক-ওয়ালা জালের মতো । পুরুষদের মজলিসেই হােক, আর মেয়েদের আসরেই হােক, গল্পগুজব হাসিতামাশা ছিল খুবই হালকা দামের । মায়ের সঙ্গিনীদের মধ্যে প্রধান ব্যক্তি ছিলেন ব্ৰজ আচার্জির বোন, র্যাকে আচার্জিনী বলে ডাকা হত । তিনি ছিলেন এ বৈঠকে দৈনিক খবর সরবরাহ করবার কাজে। প্রায় আনতেন রাজ্যির বিন্দকুটি খবর কুড়িয়ে কিংবা বানিয়ে । তাই নিয়ে গ্রহশান্তি-স্বস্ত্যয়নের হিসেব হত খুব ফলাও খরচার। এই সভায় আমি মাঝে মাঝে টাটকা পুঁথি-পড়া বিদ্যের আমদানি করেছি, শুনিয়েছি সূর্য পৃথিবী থেকে না কোটি মাইল দূরে । ঋজুপাঠ দ্বিতীয় ভাগ থেকে স্বয়ং বাল্মীকি-রোমায়ণের টুকরো আউড়ে দিয়েছি অনুস্বার-বিসর্গ সুদ্ধ ; মা জানতেন না তার ছেলের উচ্চারণ কত খাঁটি, তবু তার বিদ্যের পাল্লা সূর্যের ন কোটি মাইল রাস্তা পেরিয়ে গিয়ে ঠাকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। এ-সব শ্লোক স্বয়ং নারদমুনি ছাড়া আর কারও মুখে শোনা যেতে পারে, এ কথা কে জানত বলে । বাড়ি-ভিতরের এই ছাদটা ছিল আগাগোড়া মেয়েদের দখলে। ভঁড়ারের সঙ্গে ছিল তার বোঝাপড়া। ওখানে রোদ পড়ত পুরোপুরি, জারিক নেবুকে দিত। জারিয়ে । ঐখানে মেয়েরা বসত পিতলের গামলা-ভরা কলাইবাটা নিয়ে। টিপে টিপে টপটপ করে বড়ি দিত চুল শুকোতে শুকোতে ; দাসীরা বাসি কাপড় কোচে মেলে দিয়ে যেত রোদদূরে । তখন অনেকটা হালকা ছিল ধোবার কাজ । কঁচা আমি ফালি করে কেটে কেটে আমসি শুকনো হত, ছোটো বড়ো নানা সাইজের নানা-কাজ-করা কালো পাথরের ছাচে আমের রস থাকে থাকে জমিয়ে তোলা হত, রোদ-খাওয়া সরষের তোলে মজে উঠত। ইচড়ের আচার । কেয়াখয়ের তৈরি হত সাবধানে, তার কথাটা আমার বেশি করে মনে রাখবার মানে আছে। যখন ইস্কুলের পণ্ডিতমশায় আমাকে জানিয়ে দিলেন আমাদের বাড়ির কেয়াখয়েরের নাম র্তার শোনা আছে, অর্থ বুঝতে শক্ত ঠেকাল না। যা তার শোনা আছে সেটা তার জানা চাই। তাই বাড়ির সুনাম বজায় রাখবার জন্য মাঝে মাঝে লুকিয়ে ছাদে উঠে দুটা-একটা কেয়াখয়ের- কী বলব- চুরি করতুম বলার চেয়ে বলা ভালো অপহরণ করাতুম। কেননা রাজা-মহারাজারাও দরকার হলে, এমন-কি না হলেও, অপহরণ করে থাকেন। আর যারা চুরি করে তাদের জেলে পাঠান, শূলে চড়ান। শীতের কঁচা রৌদ্রে ছাদে বসে গল্প করতে করতে কাক তাড়াবার আর সময় কাটাবার একটা দায় দিল মেয়েদের। বাড়িতে আমি ছিলুম একমাত্র দেওর, বউদিদির আমসত্ত্ব-পাহারা, তা ছাড়া ১ কাদম্বরী দেবী, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের পত্নী