পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৪৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ছেলেবেল RSR6 সন্ধেবেলার সভা যেত ভেঙে। আমি চিরকাল ছিলুম রাত-জাগিয়ে ছেলে। সকলে শুতো যেত, আমি ঘুরে ঘুরে বেড়াতুম, ব্ৰহ্মদত্তির চেলা । সমস্ত পাড়া চুপচাপ। টাদানি রাতে ছাদের উপর সারি সারি গাছের ছায়া যেন স্বপ্নোর আলপনা। ছাদের বাইরে সিসু গাছের মাথাটা বাতাসে দুলে উঠছে, ঝিলমিল করছে পাতাগুলো। জানি নে কেন সবচেয়ে চোখে পড়ত সামনের গলির ঘুমন্ত বাড়ির ছাদে একটা ঢালু পিঠ-ওয়ালা বেঁটে চিলেকোঠা । দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কিসের দিকে যেন আঙুল বাড়িয়ে 3 রাত একটা হয়, দুটো হয় । সামনের বড়ো রান্তায় রব ওঠে, বিলো হরি হরিবোল।” Ο Σ খাচায় পাখি পোষার শখ তখন ঘরে ঘরে ছিল। সবচেয়ে খারাপ লাগত। পাড়ায় কোনো বাড়ি থেকে পিজারেতে-বাধা কোকিলের ডাক । বউঠাকরুন জোগাড় করেছিলেন চীনদেশের এক শ্যামা পাখি । কাপড়ের ঢাকার ভিতর থেকে তার শিস উঠত ফোয়ারার মতো । আরো ছিল নানা জাতের পাখি, তাদের খাচাগুলো কুলত পশ্চিমের বারান্দায় । রোজ সকালে একজন পোকাওয়ালা পাখিদের খোরাক জোগাত। তার বুলি থেকে বেরত ফড়িঙ, ছাতুখোর পাখিদের জন্যে ছাতু। জ্যোতিদাদা আমার সকল তর্কের জবাব দিতেন । কিন্তু মেয়েদের কাছে এতটা আশা করা যায় না । একবার বউঠাকরুনের মর্জি হয়েছিল খাচায় কাঠবিড়ালি পোষা। আমি বলেছিলুম কাজটা অন্যায় হচ্ছে, তিনি বলেছিলেন গুরুমশায়গিরি করতে হবে না। একে ঠিক জবাব বলা চলে না। কাজেই কথা-কাটাকাটির বদলে লুকিয়ে দুটি প্রাণীকে ছেড়ে দিতে হল। তার পরেও কিছু কথা শুনেছিলুম, কোনো জবাব করি নি । আমাদের মধ্যে একটা বাধা ঝগড়া ছিল কোনোদিন যার শেষ হল না, সে কথা বলছি। উমেশ ছিল চালাক লোক । বিলিতি দরজির দোকান থেকে ফিত-সব ছােটাকাটা নানা রঙের রেশমের ফালি জলের দরে কিনে আনত, তার সঙ্গে নেটের টুকরো আর খেলো লেস মিলিয়ে মেয়েদের জামা বানানো হত। কাগজের প্যাকেট খুলে সাবধানে মেলে ধরত মেয়েদের চোখে, বলত ‘এই হচ্ছে আজকের দিনের ফ্যাশন । ঐ মন্ত্রটার টান মেয়েরা সামলাতে পারত না। আমাকে কী দুঃখ দিত বলতে পারি নে। বার বার অস্থির হয়ে আপত্তি জানিয়েছি, জবাবে শুনেছি জ্যাঠামি করতে হবে না। আমি বউঠাকরুনকে জানিয়েছি, এর চেয়ে অনেক ভালো, অনেক ভদ্র, সেকেলে সাদা কালপোড়ে শাড়ি কিংবা ঢাকাই। আমি ভাবি আজকালকার জর্জেট-জড়ানোবউদিদিদের রঙ করা পুতুল-গড়ারূপ দেখে দেওরদের মুখে কি কোনো কথা সরছে না। উমেশের সেলাইকরা ঢাকনি-পরা বউঠাকরুন ছিলেন ভালো । চেহারার উপর এত বেশি জালিয়াতি তখন ছিল না । তর্কে বউঠাকরুনের কাছে বরাবর হেরেছি, কেননা তিনি তর্কের জবাব দিতেন না। আর হেরেছি দাবাখেলায়, সে খেলায় তার হাত ছিল পাকা । জ্যোতিদাদার কথা যখন উঠে পড়েছে তখন তঁাকে ভালো করে চিনিয়ে দিতে আরো কিছু বলার দরকার হবে। শুরু করতে হবে। আরো-একটু আগেকার দিনে। জমিদারির কাজ দেখতে প্ৰায় তাকে যেতে হত শিলাইদহে। একবার যখন সেই দরকারে বেরিয়েছিলেন নিয়েছিলেন সঙ্গে । তখনকার পক্ষে এটা ছিল বেদস্তুর, অর্থাৎ যাকে লোকে বলত পারত বাড়াবাড়ি হচ্ছে। তিনি নিশ্চয় ভেবেছিলেন, ঘর থেকে এই বাইরে চলাচল এ একটা চলতি ক্লাসের মতো। তিনি বুঝে নিয়েছিলেন, আমার ছিল আকাশে-বাতাসে-চ্যারে-বেড়ানো মন- , সেখান থেকে আমি খোরাক পাই আপনা হতেই। তার কিছুকাল পরে জীবনটা যখন আরো উপরের ক্লাসে উঠেছিল। আমি মানুষ হছিলুম। এই শিলাইদহে।