পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৪৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ ২৪৭ বসিয়াছি। এমন সময় সিড়িতে পায়ের শব্যের সঙ্গে একটা গানের স্বর শোনা গেল । বোষ্টমী গুনগুন করিতে করিতে আসিয়া আমাকে প্রণাম করিয়া কিছু দূরে মাটিতে বসিল । আমি লেখা হইতে মুখ তুলিলাম । সে বলিল, “কাল আমি তোমার প্রসাদ পাইয়াছি।” আমি বলিলাম, “সে কী কথা।” সে কহিল, “কাল সন্ধ্যার সময় কখন তোমার খাওয়া হয় আমি সেই আশায় দরজার বাহিরে বসিয়া ছিলাম। খাওয়া হইলে চাকর যখন পাত্ৰ লইয়া বাহিরে আসিল তাহাতে কী ছিল জানি না কিন্তু আমি খাইয়াছি।” আমি আশ্চর্য হইলাম। আমার বিলাত যাওয়ার কথা সকলেই জানে। সেখানে কী থাইয়াছি না-থাইয়াছি তাহা অনুমান করা কঠিন নহে, কিন্তু গোবর থাই নাই। দীর্ঘকাল মাছমাংলে আমার রুচি নাই বটে কিন্তু আমার পাচকটির জাতিকুলের কথাটা প্রকাশু সভায় আলোচনা না করাই সংগত। আমার মুখে বিস্ময়ের লক্ষণ দেখিয়া বোষ্টমী বলিল, “যদি তোমার প্রসাদ খাইতেই না পারিব, তবে তোমার কাছে আলিবার তো কোনো দরকার ছিল না।” আমি বলিলাম, "লোকে জানিলে তোমার উপর তো তাদের ভক্তি থাকিবে না।” সে বলিল, “আমি তো সকলকেই বলিয়া বেড়াইয়াছি । শুনিয়া উহারা ভাবিল, আমার এইরকমই দশা ।” বোষ্টমী যে সংসারে ছিল উহার কাছে তাহার খবর বিশেষ কিছু পাইলাম না। কেবল এইটুকু শুনিয়াছি, তাহার মায়ের অবস্থা বেশ ভালো এবং এখনো তিনি বাচিয়া আছেন । মেয়েকে যে বহু লোক ভক্তি করিয়া থাকে সে খবর তিনি জানেন । র্তাহার ইচ্ছা, মেয়ে তার কাছে গিয়া থাকে, কিন্তু আনন্দীর মন তাহাতে সায় দেয় না। অামি জিজ্ঞাসা করিলাম, "তোমার চলে কী করিয়া ।” উত্তরে শুনিলাম, তাহার ভক্তদের একজন তাহাকে সামান্ত কিছু জমি দিয়াছে । তাহারই ফসলে সেও খায়, পাচজনে খায়, কিছুতে সে আর শেষ হয় না। বলিয়া একটু হাসিয়া কছিল, “আমার তো সবই ছিল— সমস্ত ছাড়িয়া আসিয়াছি, আবার পরের কাছে মাগিয়া সংগ্ৰহ করিতেছি, ইহার কী দরকার ছিল বলে তো।” শহরে থাকিতে এ প্রশ্ন উঠিলে সহজে ছাড়িতাম না। ভিক্ষাজীবিতায় সমাজের কত অনিষ্ট তাহা বুঝাইতাম। কিন্তু, এ জায়গায় আসিলে আমার পুথিপড়া বিদ্যার সমস্ত বাজ একেবারে মরিয়া যায়। বোষ্টমীর কাছে কোনো তর্কই আমার মুখ দিয়া বাহির হইতে চাহিল না ; আমি চুপ করিয়া রছিলাম।