পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৫২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ O8S লজিকে পাশ করবার বেলায় ছাড়া ন্যায়শাস্ত্রের জোরে কেউ কোনো দিন সফলতা লাভ করেছে, এ আমি দেখি নি। সংগত যুক্তি কুতর্কের আগুনে কখনো জলের মতো কাজ করে না, বরঞ্চ তেলের মতোই কাজ করে থাকে । বাবা ভেবে রেখেছেন তিনি অন্য পক্ষকে কথা দিয়েছেন, বিবাহের ঔচিত্য সম্বন্ধে এর চেয়ে বড়ো প্রমাণ আর কিছুই নেই। অথচ আমি যদি তাহাকে স্বরণ করিয়ে দিতুম যে, পণ্ডিতমশায়কে মাও একদিন কথা দিয়েছিলেন তবু সে কথায় শুধু যে আমার বিবাহ ফেলে গেল তা নয়, পণ্ডিতমশায়ের জীবিকা ও তার সঙ্গে সহমরণে গেল— তা হলে এই উপলক্ষে একটা ফৌজদারি বাধত । বুদ্ধি বিচার এবং রুচির চেয়ে শুচিতা মন্ত্রতন্ত্র ক্রিয়াকর্ম যে ঢের ভালো, তার কবিত্ব যে স্থগভীর ও স্বন্দর, তার নিষ্ঠ যে অতি মহৎ, তার ফল ষে অতি উত্তম, সিম্বলিজমটাই যে আইডিয়ালিজম, এ কথা বাবা আজকাল আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে সময়ে অসময়ে আলোচনা করেছেন। আমি রসনাকে থামিয়ে রেখেছি কিন্তু মনকে তো চুপ করিয়ে রাখতে পারি নি। যে-কথাটা মুখের আগার কাছে এসে ফিরে যেত সেটা হচ্ছে এই যে, ‘এ-সব যদি আপনি মানেন তবে পালবার বেলায় মুরগি পালেন কেন ।’ আরও একটা কথা মনে আসত ; বাবাই একদিন দিনক্ষণ পালপার্বণ বিধিনিষেধ দীনদক্ষিণ নিয়ে তার অসুবিধা বা ক্ষতি ঘটলে মাকে কঠোর ভাষায় এ-সব অনুষ্ঠানের পগুতা নিয়ে তাড়না করেছেন। মা তখন দীনতা স্বীকার করে অবলাজাতি স্বভাবতই অবুঝ বলে মাথা হেঁট ক’রে বিরক্তির ধাক্কাটা কাটিয়ে দিয়ে ব্রাহ্মণভোজনের বিস্তারিত আয়োজনে প্রবৃত্ত হয়েছেন। কিন্তু বিশ্বকৰ্ম লজিকের পাকা ছাচে ঢালাই করে জীব স্বজন করেন নি। অতএব কোনো মানুষের কথায় বা কাজে সংগতি নেই এ কথা বলে তাকে বাগিয়ে নেওয়া যায় না, রাগিয়ে দেওয়া হয় মাত্র । ন্যায়শাস্ত্রের দোহাই পাড়লে অন্যায়ের প্রচণ্ডত বেড়ে ওঠে— যারা পোলিটিকাল বা গার্হস্থ্য অ্যাজিটেশনে শ্রদ্ধাবান তাদের এ কথাটা মনে রাখা উচিত । ঘোড়া যখন তার পিছনের গাড়িটাকে অন্যায় মনে ক’রে তার উপরে লাথি চালায় তখন অন্যায়টা তো থেকেই যায়, মাঝের থেকে তার পা'কে ৪ জখম করে। ধেীবনের আবেগে অল্প একটুখানি তর্ক করতে গিয়ে আমার সেই দশা হল । পৌরাণিকী মেয়েটির ছাত থেকে রক্ষা পাওয়া গেল বটে, কিন্তু বাবার আধুনিক যুগের তহবিলের আশ্রয়ও খোওয়ালুম। বাবা বললেন, “ষাও, তুমি আত্মনির্ভর করে গে।” আমি প্রণাম করে বললুম, “যে আজ্ঞে ।” মা বসে বসে কাদতে লাগলেন । বাবার দক্ষিণ হস্ত বিমুখ হল বটে কিন্তু মাঝখানে মা ধাৰণতে ক্ষণে ক্ষণে