পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪০৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সাহিত্যের পথে 1936t আজ যখন আমাদের গলিতে বরবধূর সত্যস্বরূপ অর্থাৎ আনন্দস্বরূপ প্রকাশ করবার ভার নিলে ঐ বাশি, তখন আমি নিজেকে জিজ্ঞাসা করলেম, কী মন্ত্রে বঁাশি আপনার কাজ সমাধা করে। আমাদের তত্ত্বজ্ঞানী তো বলে, অনিশ্চিতের দোলায় সমস্ত সংসার দোদুল্যমান ; বলে, যা দেখ কিছুই সত্য নয় । আমাদের নীতিনিপুণ বলে, ঐযে ললাটে ওরা চন্দন পরেছে, ও তো ছলনা, ওর ভিতর আছে মাথার খুলি । ঐ-যে মধুর হাসি দেখতে পাচ্ছ, ঐ হাসির পর্দা তুলে দেখে, বেরিয়ে পড়বে শুকনো দাতের পাটি। বাশি তর্ক ক’রে তার কোনো জবাব দেয় না ; কেবল তার খাম্বাজের স্বরে বলতে থাকে, খুলি বল, দাতের পাটি বল, যত কালই টিকে থাক-না কেন, ওরা মিছে ; কিন্তু ললাটে যে আনন্দের স্বগন্ধলিপি আছে, মুখে যে লজ্জার হাসির আভা দিচ্ছে, যা এখন আছে তখন নেই, যা ছায়ার মতো মায়ার মতে, যাকে ধরতে গেলে ধরা যায় না, তাই সত্য, করুণ সত্য, মধুর সত্য, গভীর সত্য। সেই সত্যকেই সংসারের সমস্ত আনাগোনার উপরে উজ্জল ক’রে ধরে বঁাশি বলছে, ‘সত্যকে যেদিন প্রত্যক্ষ দেখবে সেই দিনই উৎসব।’ বুঝলুম। কিন্তু, বিনা তর্কে বঁাশি এতবড়ো কথাটাকে সপ্রমাণ করে কী করে। এ কথাটা কাল আলোচনা করেছিলুম। বাশি একের আলো জালিয়েছে। আকাশে রাগিণী দিয়ে এমন একটি রূপের স্বষ্টি করেছে যার আর-কোনো উদ্বেগু নেই, কেবল ছনো স্বরে স্থলম্পূর্ণ এককে চরমরূপে দেখানে । সেই একের জীয়নকাটি যার উপরে পড়ল আপনার মধ্যে গভীর নিত্যসত্যের চিরজাগ্ৰত চিরসজীব স্বরূপটি সে দেখিয়ে দিলে ; বরবধূ বললে, “আমরা সামান্ত নই, আমরা চিরকালের।’ বললে, “মৃত্যুর মধ্য দিয়ে যারা আমাদের দেখে তারা মিথ্যা দেখে । আমরা অমৃতলোকের, তাই গান ছাড়া আমাদের পরিচয় আর কিছুতে দিতে পারি না। বরকনে আজ সংসারের স্রোতে ভাসমান খাপছাড়া পদার্থ নয় ; আজ তারা মধুরের ছনে একখানি কবিতার মতে, গানের মতে, ছবির মতো আপনাদের মধ্যে একের পরিপূর্ণতা দেখাচ্ছে। এই একের প্রকাশতত্বই হল স্বষ্টির তত্ত্ব, সত্যের তত্ত্ব। সংগীত কোনো-একটি রাগিণীতে যতই রমণীয় সম্পূর্ণ রূপ গ্রহণ করুক-না কেন, সাধারণ ভাষায় এবং বাহিরের দিক থেকে তাকে অসীম বলা যায় না। রূপের সীমা আছে। কিন্তু, রূপ যখন সেই সীমামাত্রকে দেখায় তখন সত্যকে দেখায় না। তার সীমাই ৰখন প্রদীপের মতো অসীমের আলো জালিয়ে ধরে তখনি সত্য প্রকাশ পায় । অাজকেকার সানাই ৰাজনাতেই এ কথা আমি অনুভব করছি। প্রথম দুই-একটা তালের পরই বুঝতে পারলুম, এ বাশিটা আনাড়ির হতে বাজছে, স্বরটা খেলো স্বর।