পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩০৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

২৯৩ রবীন্দ্র-রচনাবলী যেন মাস্টারের হাতে ইস্কুলের প্রতি বছরে পড়ানো একটা টিলে মলাটের টেক্সটবুক । আগামী দিনটার জন্য কোনো কৌতুহল ছিল না আর বর্তমান দিনটাকে পুরো মন দিয়ে অভ্যর্থনা করা ওর পক্ষে ছিল অনাবশ্বক। এখন সে এইমাত্র এসে পৌঁছোল একটা নতুন গ্রহে ; এখানে বস্তুর ভার কম ; পা মাটি ছাড়িয়ে যেন উপর দিয়ে চলে ; প্রতিমুহূর্ত ব্যগ্র হয়ে অভাবনীয়ের দিকে এগোতে থাকে ; গায়ে হাওয়া লাগে আর সমস্ত শরীরটা যেন বঁাশি হয়ে উঠতে ইচ্ছে করে ; আকাশের আলো রক্তের মধ্যে প্রবেশ করে, আর ওর অন্তরে অন্তরে যে-উত্তেজনার সঞ্চার হয় সেটা গাছের সর্বাঙ্গপ্রবাহিত রসের মধ্যে ফুলফোটাবার উত্তেজনার মতো । মনের উপর থেকে কতদিনের ধুলো-পড়া পর্দা উঠে গেল, সামান্য জিনিসের থেকে ফুটে উঠছে অসামান্যতা । তাই যোগমায়া যপন ধীরে ধীরে ঘরে এসে প্রবেশ করলেন সেই অতি সহজ ব্যাপারেও আজ অমিতকে বিস্ময় লাগল। সে মনে মনে বললে, “আহা, এ তো আগমন নয়, এ যে আবির্ভাব |" চল্লিশের কাছাকাছি তার বয়স, কিন্তু বয়সে র্তাকে শিথিল করে নি, কেবল তাকে গম্ভীর শুভ্রতা দিয়েছে। গৌরবর্ণ মুখ টস টস করছে। বৈধব্যরীতিতে চুল ছাট ; মাতৃভাবে পূর্ণ প্রসন্ন চোখ ; হাসিটি স্নিগ্ধ । মোট থান চাদরে মাথা বেষ্টন ক'রে সমস্ত দেহ সংবৃত। পায়ে জুতো নেই, দুটি পা নির্মল সুন্দর । অমিত তার পায়ে হাত দিয়ে যখন প্রণাম করলে ওর শিরে শিরে যেন দেবীর প্রসাদের ধার বয়ে গেল । প্রথম পরিচয়ের পর যোগমায়া বললেন, “তোমার কাক অমরেশ ছিলেন আমাদের জেলার সব-চেয়ে বড় উকিল ৷ একবার এক সর্বনেশে মকদ্দমায় আমরা ফতুর হতে বসেছিলুম, তিনি আমাদের বাচিয়ে দিয়েছেন । আমাকে ডাকতেন বউদিদি বলে ।” অমিত বললে, “আমি তার অযোগ্য ভাইপে। । কাক লোকসাম বঁচিয়েছেন, আমি লোকসান ঘটিয়েছি। আপনি ছিলেন তার লাভের বউদিদি, আমার হবেন লোকসানের মাসিমা ।” যোগমায়া জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমার মা আছেন ?” অমিত বললে, “ছিলেন । মাসি থাকাও খুব উচিত ছিল।" “মসির জন্যে খেদ কেন, বাবা ?” “ভেবে দেখুন না, আজ যদি ভাঙতুম মায়ের গাড়ি, বকুনির অস্ত থাকত না ; বলতেন এটা বাদরামি। গাড়িটা যদি মাসির হয় তিনি আমার অপটুতা দেপে হাসেম, মনে-মনে বলেন, ছেলেমাতুষি ।” যোগমায়া হেসে বললেন, “তাহলে না হয় গাড়িপানা মাসিরই হল ।” অমিত লাফিয়ে উঠে যোগমায়ার পায়ের ধুলো নিয়ে বললে, “এইজন্যেই তো পূর্বজন্মের