পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩২৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VD S SR রবীন্দ্র-রচনাবলী একটা কোনাে চাকরি লইবার জন্য বিন্ধ্যবাসিনী তাহাকে সর্বদাই পীড়াপীড়ি করিতে লাগিল। তিনি কান দিলেন না । স্ত্রীকে বলিলেন, তাহার উপযুক্ত চাকরি আছে বটে। কিন্তু পক্ষপাতী ইংরাজ গবর্মেন্ট সে-সকল পদে বড়ো বড়ো ইংরাজকে নিযুক্ত করে, বাঙালি হাজার যোগ্য হইলেও তাহার কোনো ! আশা নাই । শ্যামাশঙ্করী তাহার দেবার এবং মেঝো জা’র প্রতি লক্ষ্যে এবং অলক্ষ্যে সর্বদাই বাক্যবিষ প্রয়োগ মানুষ, বড়ো মানুষের মেয়ে এবং বড়ো মানুষের জামাইকে পোষণ করিবে কেমন করিয়া । সেখানে তো বেশ ছিলেন, কোনো দুঃখ ছিল না- এখানে ডালভাত খাইয়া এত কষ্ট কি সহ্য হইবে ।” শাশুড়ি বড়োবউকে ভয় করিতেন, তিনি দুর্বলের পক্ষ অবলম্বন করিয়া কোনো কথা বলিতে সাহস করিতেন না। মেজেবিউও মাসিক পঞ্চাশ টাকা বেতনের ডালভাত এবং তদীয় স্ত্রীর বাক্যঝাল খাইয়া নীরবে পরিপাক করিতে লাগিল । ইতিমধ্যে বড়ো ভাই ছুটিতে কিছুদিনের জন্য ঘরে আসিয়া স্ত্রীর নিকট হইতে অনেক উদ্দীপনাপূর্ণ ওজোগুণসম্পন্ন বক্তৃতা শ্রবণ করিতে লাগিলেন । অবশেষে নিদ্রার ব্যাঘাত যখন প্রতি রাত্রেই গুরুতর হইয়া উঠিতে লাগিল তখন একদিন অনাথবন্ধুকে ডাকিয়া শান্তভাবে স্নেহের সহিত কহিলেন, “তোমার একটা চাকরির চেষ্টা দেখা উচিত, কেবল আমি একলা সংসার চালাইব কী করিয়া ।” অনাথবন্ধু পদাহিত সৰ্পের ন্যায় গর্জন করিয়া বলিয়া উঠিলেন, দুই বেলা দুই মুষ্টি অত্যন্ত অখাদ্য মোটা ভাতের পর এত খোটা সহ্য হয় না । তৎক্ষণাৎ স্ত্রীকে লইয়া শ্বশুরবাড়ি যাইতে সংকল্প করিলেন । কিন্তু, স্ত্রী কিছুতেই সম্মত হইল না । তাহার মতে ভাইয়ের অন্ন এবং ভাজের গালিতে কনিষ্ঠের পারিবারিক অধিকার আছে কিন্তু শ্বশুরের আশ্রয়ে বড়ো লজ্জা । বিন্ধ্যবাসিনী শ্বশুরবাড়িতে দীনহীনের মতো নত হইয়া থাকিতে পারে, কিন্তু বাপের বাড়িতে সে আপন মর্যাদা রক্ষা করিয়া মাথা তুলিয়া চলিতে চায় । এমন সময় গ্রামের এনট্রেনসন্ধুলে তৃতীয় শিক্ষকের পদ খালি হইল । অনাথবন্ধুর দাদা এবং বিন্ধ্যবাসিনী উভয়েই তাহাকে এই কাজটি গ্রহণ করিবার জন্য পীড়াপীড়ি করিয়া ধরিলেন । তাহাতেও হিতে বিপরীত হইল । নিজের ভাই এবং একমাত্র ধর্মপত্নী যে তঁাহাকে এমন একটা অত্যন্ত তুচ্ছ কাজের যোগ্য বলিয়া মনে করিতে পারেন। ইহাতে তাহার মনে দুৰ্জয় অভিমানের সঞ্চার হইল এবং সংসারের ও সমস্ত কাজকর্মের প্রতি পূর্বাপেক্ষা চতুগুণ বৈরাগ্য জন্মিয়া গেল । তখন আবার দাদা তাহার হাতে ধরিয়া, মিনতি করিয়া, তাহাকে অনেক করিয়া ঠাণ্ডা করিলেন । সকলেই মনে করিলেন, ইহাকে আর কোনো কথা বলিয়া কাজ নাই, এ এখন কোনো প্রকারে ঘরে টিকিয়া গেলেই ঘরের সৌভাগ্য । ছুটি অন্তে দাদা কর্মক্ষেত্রে চলিয়া গেলেন ; শ্যামাশঙ্করী রুদ্ধ আক্ৰোশে মুখখানা গোলাকার করিয়া তুলিয়া একটা বৃহৎ কুদর্শনচক্র নির্মাণ করিয়া রহিলেন । অনাথবন্ধু বিন্ধ্যবাসিনীকে আসিয়া কহিলেন, “আজকাল বিলাতে না গেলে কোনো ভদ্র চাকরি পাওয়া যায় না ; আমি বিলা৩ে. যাইতে মনস্থ করিতেছি, তুমি তোমার বাবার কাছ হইতে কোনো ছুতায় কিছু অর্থ সংগ্রহ করো ।” এক তো বিলাত যাইবার কথা শুনিয়া বিন্ধ্যর মাথায় যেন বজাঘাত হইল ; তাহার পরে পিতার কাছে কী করিয়া অর্থ ভিক্ষা করিতে যাইবে, তাহা সে মনে করিতে পারিল না এবং মনে করিতে গিয়া লজায় মরিয়া গেল । শ্বশুরের কাছে নিজমুখে ঢাকা চাহিতেও অনাথবন্ধুর অহংকারে বাধা দিল অথচ বাপের কাছ হইতে কন্যা কেন যে ছলে অথবা বলে অর্থ আকর্ষণ করিয়া না আনিবে তাহা তিনি বুঝিতে পারিলেন না । ইহা লইয়া অনাথ অনেক রাগার।াগি করিলেন এবং মর্মপীড়িত বিন্ধ্যবাসিনীকে বিস্তর আক্ৰপাত করিতে ठ्ठळत ।