পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৩০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

w) Sb রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী রহিল । সন্ধ্যা হইয়া আসিল । দীপহীন গৃহকোণে অন্ধকার ঘনীভূত হইতে লাগিল । দৈবক্রমে একজন পুরাতন প্রণয়ী আসিয়া ‘ক্ষীরো ক্ষীরো’ শব্দে দ্বারে আঘাত করিতে লাগিল। ক্ষীরোদা অকস্মাৎ দ্বার পলায়নের পথ অবলম্বন করিলা । ছেলেটা ক্ষুধার জ্বালায় কঁাদিয়া কঁাদিয়া খাটের নীচে ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল, সেই গোলমালে জাগিয়া উঠিয়া অন্ধকারের মধ্য হইতে ভগ্নকাতর কণ্ঠে “মা মা” করিয়া বঁকাদিতে লাগিল । তখন ক্ষীরোদা সেই রোরুদ্যমান শিশুকে প্ৰাণপণে বক্ষে চাপিয়া ধরিয়া বিদ্যুদবেগে ছুটিয়া নিকটবতী কুপের মধ্যে ঝাপাইয়া পড়িল । শব্দ শুনিয়া আলো হস্তে প্রতিবেশীগণ কুপের নিকট আসিয়া উপস্থিত হইল। ক্ষীরোদা এবং শিশুকে তুলিতে বিলম্ব হইল না । ক্ষীরোদা। তখন অচেতন এবং শিশুটি মরিয়া গেছে। হাসপাতালে গিয়া ক্ষীরোদা আরোগ্য লাভ করিল । হত্যাপরাধে ম্যাজিস্ট্রেট তাহাকে সেসনে চালান করিয়া দিলেন । জজ মোহিতমোহন দত্ত স্ট্যাটু্যটরি সিভিলিয়ান । তাহার কঠিন বিচারে ক্ষীরোদার ফাঁসির হুকুম হইল । হতভাগিনীর অবস্থা-বিবেচনা করিয়া উকিলগণ তাহাকে বঁাচাইবার জন্য বিস্তর চেষ্টা করিলেন কিন্তু কিছুতেই কৃতকার্য হইলেন না । জজ তাহাকে তিলমাত্র দয়ার পাত্রী বলিয়া মনে করিতে পারিলেন না | না পারিবার কারণ আছে ; এক দিকে তিনি হিন্দুমহিলাগণকে দেবী আখ্যা দিয়া থাকেন, অপর দিকে স্ত্রীজাতির প্রতি তাহার। আন্তরিক অবিশ্বাস । তাহার মত এই যে, রমণীগণ কুলবন্ধন ছেদন করিবার জন্য উন্মুখ হইয়া আছে, শাসন তিলমাত্র শিথিল হইলেই সমাজপিঞ্জরে একটি কুলনারীও অবশিষ্ট থাকিবে না | তাহার এরূপ বিশ্বাসেরও কারণ আছে। সে কারণ জানিতে গেলে মোহিতের যৌবন-ইতিহাসের কিয়দংশ আলোচনা করিতে হয় । মোহিত যখন কলেজে। সেকেন্ড ইয়ারে পড়িতেন তখন আকারে এবং আচারে এখনকার হইতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র প্রকারের মানুষ ছিলেন । এখন মোহিতের সম্মুখে টাক, পশ্চাতে টিকি, মুণ্ডিত মুখে প্ৰতিদিন প্ৰাতঃকালে খরক্ষুরধারে গুম্ফশ্বাশ্রণীর অন্ধুর উচ্ছেদ হইয়া থাকে ; কিন্তু তখন তিনি সোনার চশমায়, গোফদাড়িতে এবং সাহেবি ধরনের কেশবিন্যাসে উনবিংশ শতাব্দীর নূতন সংস্করণ কার্তিকটির মতো ছিলেন । বেশভূষায় বিশেষ মনোযোগ ছিল, মদ্যমাংসে অরুচি ছিল না এবং আনুষঙ্গিক আরো দুটাে-একটা উপসর্গ ছিল । অদূরে একঘর গৃহস্থ বাস করিত। তাঁহাদের হেমশশী-বলিয়া এক বিধবা কন্যা ছিল । তাহার বয়স অধিক হইবে না । চৌদ্দ হইতে পনেরোয় পড়িবে। সমুদ্র হইতে বনরাজিনীলা তটভূমি যেমন রমণীয় স্বপ্লবৎ চিত্ৰবৎ মনে হয় এমন তীরের উপর উঠিয়া হয় না । বৈধব্যের বেষ্টন-অন্তরালে হেমশশী সংসার হইতে যেটুকু দূরে পড়িয়াছিল। সেই দূরত্বের বিচ্ছেদাবশত সংসারটা তাহার কাছে পরপরবতী পরামরহস্যময় প্ৰমোদবনের মতো ঠেকিত । সে জানিত না এই জগৎ-যন্ত্রটার কলকারখানা অত্যন্ত জটিল এবং লৌহকঠিন- সুখে দুঃখে, সম্পর্কে বিপদে, সংশয়ে সংকটে ও নৈরাশ্যে পরিতাপে বিমিশ্রিত । তাহার মনে হইত, সংসারযাত্ৰা কলনর্দিনী, নিঝরিণীর স্বচ্ছ জলপ্রবাহের মতো সহজ, সম্মুখবর্তী সুন্দর পৃথিবীর সকল পথগুলিই প্রশস্ত ও সরল, সুখ কেবল তাহার বাতায়নের বাহিরে এবং তৃপ্তিহীন আকাঙক্ষা কেবল তাহার বক্ষপঞ্জীরবর্তী স্পদিত