পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৩৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী ܓ ܓ 9 দক্ষিণাচরণবাবু বিবর্ণমুখে বিস্মফারিত নেত্ৰে কহিলেন, “আজ রাত্রে আবার সেইরূপ উপদ্রব আরম্ভ হইয়াছে— তোমার ঔষধ কোনো কাজে লাগিল না ।” আমি কিঞ্চিৎ সসংকোচে বলিলাম, “আপনি বোধ করি মদের মাত্রা আবার বাড়াইয়াছেন ।” দক্ষিণাচরণবাবু অত্যন্ত রিরক্ত হইয়া কহিলেন, “ওটা তোমার ভারি ভ্ৰম । মদ নাহে ; আদ্যোপান্ত বিবরণ না শুনিলে তুমি আসল কারণটা অনুমান করিতে পরিবে না ।” কুলুঙ্গির মধ্যে ক্ষুদ্র টিনের ডিবায় স্নানভাবে কেরোসিন জ্বলিতেছিল, আমি তাহা উসকাইয়া । দিলাম । একটুখানি আলো জাগিয়া উঠিল এবং অনেকখানি ধোয়া বাহির হইতে লাগিল । কেঁচাখানা গায়ের উপর টানিয়া একখানা খবরের-কাগজ-পাতা প্যাকবাক্সের উপর বসিলাম । দক্ষিণাচরণবাবু বলিতে লাগিলেন আমার প্রথমপক্ষের স্ত্রীর মতো এমন গৃহিণী অতি দুর্লভ ছিল । কিন্তু আমার তখন বয়স বেশি ছিল না, সহজেই রসাধিক্য ছিল, তাহার উপর আবার কাব্যশাস্ত্রটা ভালো করিয়া অধ্যয়ন করিয়াছিলাম, তাই অবিমিশ্র গৃহিণীপনায় মন উঠিত না ! কালিদাসের সেই শ্লোকটা প্ৰায় মনে উদয় হইত— গৃহিণী সচিবঃ সখী মিথঃ প্রিয়শিষ্য ললিতে কলাবিধেী । কিন্তু আমার গৃহিণীর কাছে ললিত কলাবিধির কোনো উপদেশ খাটিত না এবং সখীভাবে প্রণয়সম্ভাষণ তেমনি তাহার হাসির মুখে বড়ো বড়ো কাব্যের টুকরা এবং ভালো ভালো আদরের সম্ভাষণ মুহুর্তের BBB BBDu BB DBuBS KSuJSS 0uB BBB BuBuuBB uBueBeBB DDD S তাহার পর, আজ বছর চাৱে থািক হইল অামাকে সাংঘাতিক রোগে ধরিল । ওষ্ঠ ব্ৰণ হইয়া জ্বরবিকার হইয়া, মরিবার দাখিল হইলাম ; বাচিবার আশা ছিল না ; একদিন এমন হইল যে, ডাক্তারে জবাব দিয়া গেল । এমন সময় আমার এক আত্মীয় কোথা হইতে এক ব্ৰহ্মচারী আনিয়া উপস্থিত করিল ; সে গাব্য ঘূতের সহিত একটা শিকড় বাটিয়া আমাকে খাওয়াইয়া দিল ! ঔষধের গুণেই হউক বা অদৃষ্টক্রমেই হউক সে-যাত্ৰা বাচিয়া গোলাম । রোগের সময় আমার স্ত্রী অতর্নিশি এক মুহুর্তের জন্য বিশ্রাম করেন নাই । সেই ক'টা দিন একটি অবলা স্ত্রীলোক, মানুষের সামান্য শক্তি লইয়া প্ৰাণপণ ব্যাকুলতার সহিত, দ্বারে সমাগত যমদূতগুলার সঙ্গে অনবরত যুদ্ধ করিয়াছিলেন । তাহার সমস্ত প্ৰেম, সমস্ত হৃদয়, সমস্ত যত্ন দিয়া আমার এই অযোগ্য প্ৰাণটাকে যেন বক্ষের শিশুর মতো দুই হস্তে ঝাপিয়া ঢাকিয়া রাখিয়াছিলেন । আহার ছিল না, নিদ্রা ছিল না, জগতের আর-কোনো-কিছুর প্রতিই দৃষ্টি ছিল না । যম তখন পর্যাহত ব্যাঘের ন্যায় আমাকে তাহার কবল হইতে ফেলিয়া দিয়া চলিয়া গেলেন, কিন্তু, যাইবার সময় আমার স্ত্রীকে একটা প্ৰবল থাবা মারিয়া গেলেন । আমার স্ত্রী তখন গর্ভবতী ছিলেন, অনতিকাল পরে এক মৃত সন্তান প্রসব করিলেন । তাহার পর হইতেই তাহার নানাপ্রকার জটিল ব্যামোর সূত্রপাত হইল । তখন আমি তাহার সেবা আরম্ভ করিয়া দিলাম । তাহাতে তিনি বিব্রত হইয়া উঠিলেন । বলিতে লাগিলেন, “আঃ, করো কী । লোকে বলিবে কী ! আমন করিয়া দিনরাত্ৰি তুমি আমার ঘরে যাতায়াত করিয়ো না ।” যেন নিজে পাখা খাইতেছি, এইরূপ ভান করিয়া রাত্রে যদি তাহাকে তাহার জ্বরের সময় পাখা করিতে যাইতাম তো ভারি একটা কাড়াকড়ি ব্যাপার পড়িয়া যাইত। কোনোদিন যদি তাহার শুশ্রুষা উপলক্ষে আমার আহারের নিয়মিত সময় দশ মিনিট উত্তীর্ণ হইয়া যাইত, তবে সেও নানাপ্রকার অনুনয় অনুরোধ অনুযোগের কারণ হইয়া দাড়াইত । স্বল্পমাত্র সেবা করিতে গেলে হিতে বিপরীত হইয়া উঠিত । তিনি বলিতেন, “পুরুষমানুষের অতটা বাড়াবাড়ি ভালো নয় ।” আমাদের সেই বরানগরের বাড়িটি বোধ করি তুমি দেখিয়াছ । বাড়ির সামনেই বাগান এবং বাগানের সম্মুখেই গঙ্গা বহিতেছে! আমাদের শোবার ঘরের নীচেই দক্ষিণের দিকে খানিকটা জমি