পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৫৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

V8 V রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী সমস্তই বিস্মৃত হইয়া গেল ; মনে করিল, এমন এক জায়গায় আসিয়াছে যেখানে বন্ধনমুক্ত সৌন্দর্যপূর্ণ স্বাধীনতার কোনো বাধামাত্র নাই । ] সুধো মাঝে মাঝে আসিয়া ভীতস্বরে কানে কানে বলে, “বউঠাকরুন, এই বেলা বাড়ি ফিরিয়া চলো ; দাদাবাবু জানিতে পারিলে রক্ষা থাকিবে না।” গিরিবালা সে কথায় কৰ্ণপাত করে না । তাহার মনে এখন আর কিছুমাত্র ভয় নাই । । অভিনয় অনেক দূর অগ্রসর হইল । রাধার দুর্জয় মান হইয়াছে ; সে মানসাগরে কৃষ্ণ আর কিছুতেই থই পাইতেছে না ; কত অনুনয়বিনয় সাধাসাধি কাদার্ক্যাদি, কিছুতেই কিছু হয় না । তখন গর্বভরে গিরিবালার বক্ষ ফুলিতে লাগিল । কৃষ্ণের এই লাঞ্ছনায় সে যেন মনে মনে রাধা হইয়া নিজের অসীম প্ৰতাপ নিজে অনুভব করিতে লাগিল । কেহ তাহাকে কখনো এমন করিয়া সাধে নাই ; সে অবহেলিত অবমানিত পরিত্যক্ত স্ত্রী, কিন্তু তবু সে এক অপূর্ব মোহে স্থির করিল যে, এমন করিয়া নিষ্ঠুরভাবে কাদাইবার ক্ষমতা তাহারও আছে। সৌন্দর্যের যে কেমন দোর্দণ্ড প্রতাপ তাহা সে কানে শুনিয়াছে, অনুমান করিয়াছে মাত্ৰ— আজি দীপের আলোকে, গানের সুরে, সূদৃশ্য রঙ্গমঞ্চের উপরে তাহা সুস্পষ্টরূপে প্ৰত্যক্ষ করিল। নেশায় তাহার সমস্ত মস্তিষ্ক ভরিয়া উঠিল । অবশেষে যবনিকাপাতন হইল, গ্যাসের আলো স্নান হইয়া আসিল, দর্শকগণ প্ৰস্থানের উপক্রম করিল ; গিরিবালা মন্ত্রমুগ্ধের মতো বসিয়া রহিল । এখান হইতে উঠিয়া যে বাড়ি যাইতে হইবে এ কথা তাহার মনে ছিল না । সে ভাবিতেছিল অভিনয় বুঝি ফুরাইবে না, যবনিকা আবার উঠিবে । রাধিকার নিকট শ্ৰীকৃষ্ণের পরাভব, জগতে ইহা ছাড়া আর কোনো বিষয় উপস্থিত নাই । সুধো কহিল, “বউঠাকরুন, করো কী, ওঠে, এখনই সমস্ত আলো নিবাইয়া দিবে ।” গিরিবালা গভীর রাত্রে আপনি শয়নকক্ষে ফিরিয়া আসিল । কোণে একটি দীপ মিটমিট করিতেছে— ঘরে একটি লোক নাই, শব্দ নাই— গৃহপ্ৰান্তে নির্জন শয্যার উপরে একটি পুরাতন মশারি বাতাসে অল্প অল্প দুলিতেছে ; তাহার প্রতিদিনের জগৎ অত্যন্ত বিশ্ৰী বিবস এবং তুচ্ছ বলিয়া ঠেকিতে লাগিল । কোথায় সেই সৌন্দর্যময় আলোকময় সংগীতময় রাজ্য- যেখানে সে আপনার সমস্ত মহিমা বিকীর্ণ করিয়া দিয়া জগতের কেন্দ্ৰস্থলে বিরাজ করিতে পারে- যেখানে সে অজ্ঞাত অবজ্ঞাত তুচ্ছ সাধারণ নারীমাত্র নহে । এখন হইতে সে প্ৰতি সপ্তাহেই থিয়েটারে যাইতে আরম্ভ করিল । কালক্রমে, তাহার সেই প্ৰথম মোহ অনেকটা পরিমাণে হাস হইয়া আসিল— এখন সে নটনােটাদের মুখের রঙচঙে, সৌন্দর্যের অভাব, অভিনয়ের কৃত্রিমতা সমস্ত দেখিতে পাইল । কিন্তু তবু তাহার নেশা ছুটিল না । রণসংগীত শুনিলে যোদ্ধার হৃদয় যেমন নাচিয়া উঠে, রঙ্গমঞ্চের পট উঠিয়া গেলেই তাহার বক্ষের মধ্যে সেইরূপ আন্দোলন উপস্থিত হইত। । ঐ যে সমস্ত সংসার হইতে স্বতন্ত্র সুদৃশ্য সমুচ্চ সুন্দর বেদিকা স্বৰ্ণলেখায় অঙ্কিত, চিত্রপটে সজ্জিত, কাব্য এবং সংগীতের ইন্দ্ৰজালে মায়ামণ্ডিত, অসংখ্য মুগ্ধদৃষ্টির দ্বারা আক্রান্ত, নেপথ্যভূমির গোপনতার দ্বারা অপূর্বরহস্যপ্ৰাপ্ত, উজ্জ্বল আলোকমালায় সর্বসমক্ষে সুপ্ৰকাশিতবিশ্ববিজয়িনী সৌন্দর্যরাজ্ঞীর পক্ষে এমন মায়াসিংহাসন আর কোথায় আছে । প্ৰথমে যেদিন সে তাহার স্বামীকে রঙ্গভূমিতে উপস্থিত দেখিল, এবং যখন গোপীনাথ কোনো নটীর অভিনয়ে উন্মত্ত উচ্ছাস প্রকাশ করিতে লাগিল, তখন স্বামীর প্রতি তাহার মনে প্ৰবল অবজ্ঞার উদয় হইল । সে জর্জরিত চিত্তে মনে করিল, যদি কখনো এমন দিন আসে যে, তাহার স্বামী তাহার রূপে আকৃষ্ট হইয়া দগ্ধপক্ষ পতঙ্গের মতো তাহার পদতলে আসিয়া পড়ে, এবং সে আপনি চরণানখরের প্রান্ত হইতে উপেক্ষা বিকীর্ণ কবিয়া দিয়া অভিমানভারে চলিয়া যাইতে পারে, তবেই তাহার এই ব্যথা রূপ ব্যর্থ যৌবন সার্থকতা লাভ করিবে । কিন্তু সে শুভদিন আসিল কই । আজকাল গোপীনাথের দর্শন পাওয়াই দুর্লভ হইয়াছে। সে আপন প্ৰমত্ততার ঝড়ের মুখে ধূলি-ধ্বজের মতো একটা দল পাকাইয়া ঘুরিতে ঘুরিতে কোথায় চলিয়া গিয়াছে তাহার। আর ঠিকানা নাই ।