পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৮৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ । \OQ সকলেই ব্যথিতচিত্তে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া ভাবিল, ইহারই মধ্যে শেষ হইল কেন। সজলনয়না অন্নপূর্ণার ইচ্ছা করিতে লাগিল, ছেলেটিকে কোলে বসাইয়া বক্ষে চাপিয়া তাহার মস্তক আত্মাণ করেন । মতিলালবাবু ভাবিতে লাগিলেন, এই ছেলেটিকে যদি কোনোমতে কাছে রাখিতে পারি তুমি পুত্রের অভাব পূর্ণ হয়। কেবল ক্ষুদ্র বালিকা চারুপীর অন্ধকারণ ঈর্ষ ও বিষয়ে পরিপূর্ণ হইয়া তৃতীয় পরিচ্ছেদ চারুশশী তাহার পিতামাতার একমাত্র সন্তান, তাহাদের পিতৃমাতৃস্নেহের একমাত্র অধিকারিণী । তাহার খেয়াল এবং জেদের অন্ত ছিল না। খাওয়া, কাপড় পরা, চুল বাধা সম্বন্ধে তাহার নিজের স্বাধীন মত ছিল ; কিন্তু সে মতের কিছুমাত্র স্থিরতা ছিল না । যেদিন কোথাও নিমন্ত্রণ থাকিত সেদিন তাহার মায়ের ভয় হইত, পাছে মেয়েটি সাজসজ্জা সম্বন্ধে একটা অসম্ভব জেদ ধরিয়া বসে । যদি দৈবাৎ একবার চুল বাধাটা তাহার মনের মতো না হইল। তবে সেদিন যতবার চুল খুলিয়া যতরকম করিয়া বাধিয়া দেওয়া যাক কিছুতেই তাহার মন পাওয়া যাইবে না, অবশেষে মহা কান্নাকাটির পালা পড়িয়া যাইবে । সকল বিষয়েই এইরূপ । আবার এক-এক সময় চিত্ত যখন প্ৰসন্ন থাকে তখন কিছুতেই তাহার কোনো আপত্তি থাকে না। তখন সে অতিমাত্রায় ভালোবাসা প্ৰকাশ করিয়া তাহার মাকে জড়াইয়া ধরিয়া, চুম্বন করিয়া, হাসিয়া বকিয়া,একেবারে অস্থির করিয়া তোলে। এই ক্ষুদ্র মেয়েটি একটি দুর্ভেদ্য প্ৰহেলিকা । এই বালিকা তাহার দুর্বাধ্য হৃদয়ের সমস্ত বেগ প্রয়োগ করিয়া মনে মনে তারাপদকে সুতীব্র বিদ্বেষে তাড়না করিতে লাগিল। পিতামাতাকেও সর্বতোভাবে উদবেজিত করিয়া তুলিল। আহারের সময় রোদনোন্মুখী হইয়া ভোজনের পাত্র ঠেলিয়া ফেলিয়া দেয়, রন্ধন তাহার রুচিকর বোধ হয় না, দাসীকে মারে, সকল বিষয়েই অকারণ অভিযোগ করিতে থাকে । তারাপদর বিদ্যাগুলি যতই তাহার এবং অন্য সকলের মনোরঞ্জন করিতে লাগিল ততই যেন তাহার রাগ বাড়িয়া উঠিল । তারাপদর যে কোনো গুণ । আছে ইহা স্বীকার করিতে তাহার মন বিমুখ হইল, অথচ তাহার প্রমাণ যখন প্রবল হইতে লাগিল তাহার অসন্তোষের মাত্রাও উচ্চে উঠিল । তারাপদ যেদিন কুশলবের গান করিল সেদিন অন্নপূর্ণ মনে করিলেন, ‘সংগীতে বনের পশু বিশ হয়, আজ বােধ হয় আমার মেয়ের মন গলিয়াছে।’ তাহাকে । জিজ্ঞাসা করিলেন, “চারু, কেমন লাগল।” সে কোনো উত্তর না দিয়া অত্যন্ত প্রবলবেগে মাথা নাডিয়া দিল । এই ভঙ্গিটিকে ভাষায় তর্জমা করিলে এইরূপ দাড়ায়- কিছুমাত্র ভালো লাগে নাই এবং কোনোকালে ভালো লাগিবে না । চারুর মনে ঈর্ষার উদয় হইয়াছে বুঝিয়া তাহার মাতা চারুর সম্মুখে তারাপদর প্রতি স্নেহ প্ৰকাশ করিতে বিরত হইলেন। সন্ধ্যার পরে যখন সকাল সকাল খাইয়া চারু শয়ন করিত তখন অন্নপূর্ণ নীেকাকক্ষের দ্বারের নিকট আসিয়া বসিতেন এবং মতিবাবু ও তারাপদ বাহিরে বসিত এবং অন্নপূর্ণার ( অনুরোধে তারাপদ গান আরম্ভ করিত ; তাহার গানে যখন নদীতীরের বিশ্রামনিরতা গ্ৰামশ্ৰী সন্ধ্যার বিপুল অন্ধকারে মুগ্ধ নিস্তব্ধ হইয়া রহিত এবং অন্নপূর্ণর কোমল হৃদয়খনি স্নেহে ও সৌন্দর্যরসে উচ্ছলিত হইতে থাকিত তখন হঠাৎ চারু দ্রুতপদে বিছানা হইতে উঠিয়া আসিয়া সরোষসরোদনে বলিত, “মা, তোমরা কী গোল করছ, আমার ঘুম হচ্ছে না।” পিতামাতা তাহাকে একলা ঘুমাইতে পাঠাইয়া তারাপদকে ঘিরিয়া সংগীত উপভোগ করিতেছেন। ইহা তাহার একান্ত অসহ্য হইয়া উঠিত । এই দীপ্তকৃষ্ণনয়না বালিকার স্বাভাবিক সুতীব্রতা তারাপদর নিকটে অত্যন্ত কৌতুকজনক বোধ হইত। সে ইহাকে গল্প শুনাইয়া, গান গাহিয়া, বাঁশি বাজাইয়া বশ করিতে অনেক চেষ্টা করিল ; কিন্তু কিছুতেই । কৃতকাৰ্য হইল না। কেবল তারাপদ মধ্যাহ্নে যখন নদীতে স্নান করিতে নামিত, পরিপূর্ণ জলরাশির মধ্যে গীেরবর্ণ সরল তনু দেহখানি নানা সন্তরণভঙ্গিতে অবলীলাক্রমে সঞ্চালন করিয়া তরুণ