পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৯৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VObrS রবীন্দ্র-রচনাবলী একদিন রায়ডাঙার বাবুদের বাড়ি হইতে মেয়ে দেখিতে আসিল । চারুকে বেশভূষা পরাইয়া বাহির কিরিবার চেষ্টা করা হইল । সে শোবার ঘরের দ্বার রুদ্ধ করিয়া বসিয়া রহিল, কিছুতেই বাহির হইল না । মাতিবাবুঘরের বাহির হইতে অনেক অনুনয় করিলেন, ভৎসনা করিলেন, কিছুতেই কিছু ফল হইল না । অবশেষে বাহিরে আসিয়া রায়ডাঙার দূতবর্গের নিকট মিথ্যা করিয়া বলিতে হইল, কন্যার হঠাৎ অত্যন্ত অসুখ করিয়াছে আজ আর দেখানাে হইবে না। তাহারা ভাবিল, মেয়ের বুঝি কোনাে-একটা দোষ আছে, তাই এইরূপ চাতুরী অবলম্বন করা হইল । তখন মতিবাবু ভাবিতে লাগিলেন, তারাপদ ছেলেটি দেখিতে শুনিতে সকল হিসাবেই ভালো ; হইবে না । ইহাও চিন্তা করিয়া দেখিলেন, তাহার অশান্ত অবাধ্য মেয়েটির দুরন্তাপনা তাহাদের স্নেহের চক্ষে যতই মার্জনীয় বোধ হউক, শ্বশুরবাড়িতে কেহ সহ্য করিবে না । তখন স্ত্রী-পুরুষে অনেক আলোচনা করিয়া তারাপদর দেশে তাহার সমস্ত কৌলিক সংবাদ সন্ধান করিবার জন্য লোক পাঠাইলেন । খবর আসিল যে, বংশ ভালো, কিন্তু দরিদ্র । তখন মতিবাবু ছেলের মা এবং ভাইয়ের নিকট বিবাহের প্রস্তাব পাঠাইলেন। তাহারা আনন্দে উচ্ছসিত হইয়া সম্মতি দিতে -মুহুর্তমাত্র বিলম্ব করিলেন না । । r কঁঠালিয়ার মতিবাবু এবং অন্নপূর্ণ বিবাহের দিনক্ষণ আলোচনা করিতে লাগিলেন, কিন্তু স্বাভাবিক গোপনতাপ্রিয় সাবধানী মতিবাবু কথাটা গোপনে রাখিলেন । চারুকে ধরিয়া রাখা গেল না । সে মাঝে মাঝে বগির হাঙ্গামার মতো তারাপদর পাঠগৃহে গিয়া পড়িত । কখনো রাগ, কখনো অনুরাগ, কখনো বিরাগের দ্বারা তাহার পাঠচৰ্যার নিভৃত শান্তি অকস্মাৎ তরঙ্গিত করিয়া তুলিত । তাহাতে আজকাল এই নির্লিপ্ত মুক্তস্বভাব ব্ৰাহ্মণবালকের চিত্তে মাঝে মাঝে ক্ষণকালের জন্য বিদ্যুৎস্পন্দনের ন্যায় এক অপূর্ব চাঞ্চল্য সঞ্চার হইত। যে ব্যক্তির লঘুভার চিত্ত চিরকাল অক্ষুন্ন অব্যাহতভাবে কালস্রোতের তরঙ্গচূড়ায় ভাসমান হইয়া সম্মুখে প্রবাহিত হইয়া যাইত, সে আজকাল এক-একবার অন্যমনস্ক হইয়া বিচিত্র দিবাস্বল্পজালের মধ্যে জড়ীভূত হইয়া পড়ে। এক-একদিন পড়াশুনা ছাড়িয়া দিয়া সে মতিবাবুর লাইব্রেরির মধ্যে প্রবেশ করিয়া ছবির বইয়ের পাতা উলটাইতে থাকিত ; সেই ছবিগুলির মিশ্রণে যে কল্পনালোক সৃজিত হইত। তাহা পূর্বেকার হইতে অনেক স্বতন্ত্র এবং অধিকতর রঙিন । চারুর অদ্ভুত আচরণ লক্ষ্য করিয়া সে আর পূর্বের মতো স্বভাবত পরিহাস করিতে পারিত না, দুষ্টামি করিলে তাহাকে মারিবার কথা মনেও উদয় হইত না । নিজের এই গৃঢ় পরিবর্তন, এই আবদ্ধ আসক্ত ভাব তাহার নিজের কাছে এক নূতন স্বপ্নের মতো মনে হইতে লাগিল । শ্রাবণ মাসে বিবাহের শুভদিন স্থির করিয়া মতিবাবু তারাপদর মা ও ভাইদের আনিতে পাঠাইলেন, তারাপদকে তাহা জানিতে দিলেন না। কলিকাতার মোক্তারকে গড়ের বাদ্য বায়না দিতে আদেশ করিলেন এবং জিনিসপত্রের ফর্দ পাঠাইয়া দিলেন । আকাশে নববর্ষার মেঘ উঠিল। গ্রামের নদী এতদিন শুষ্কপ্রায় হইয়া ছিল, মাঝে মাঝে কেবল এক-একটা ডোবায় জল বাধিয়া থাকিত ; ছোটাে ছোটাে নীেকা সেই পঙ্কিল জলে ডোবানো ছিল এবং শুষ্ক নদীপথে গোরুর গাড়ি-চলাচলের সুগভীর চক্ৰচিহ্ন খোদিত হইতেছিল- এমন সময় একদিন, পিতৃগৃহপ্ৰত্যাগত পার্বতীর মতো কোথা হইতে দ্রুতগামিনী জলধারা কলহাস্যসহকারে গ্রামের শূন্যবক্ষে আসিয়া সমাগত হইল- উলঙ্গ বালক-বালিকার তীরে আসিয়া উচ্চৈঃস্বরে নৃত্য করিতে লাগিল, অতৃপ্ত আনন্দে বারংবার জলে ঝাপ দিয়া দিয়া নদীকে যেন আলিঙ্গন করিয়া ধরিতে লাগিল, কুটিরবাসিনীরা তাহদের পরিচিত প্ৰিয়সঙ্গিনীকে দেখিবার জন্য বাহির হইয়া আসিল- শুক নিজীব গ্রামের মধ্যে কোথা হইতে এক প্রবল বিপুল প্ৰাণহিল্লোল আসিয়া প্ৰবেশ করিল। দেশবিদেশ হইতে বোঝাই হইয়া ছোটো বড়ো নানা আয়তনের নীেকা আসিতে লাগিল, বাজারের ঘাট সন্ধ্যাবেলায় বিদেশী মাঝির সংগীতে ধ্বনিত হইয়া উঠিল। দুই তীরের গ্রামগুলি সম্বৎসর আপনার নিভৃত কোণে