পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪২০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8○Wり রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী হয়ে দেখা দিল, কলের চিমনিগুলো প্ৰকৃতির বঁাকা ভঙ্গিমার উপর তার সোজা আঁচড় কাটতে লাগল, তখন দেখতে পেলুম মানুষের রিপু জগতে কী কুগ্ৰীতাই সৃষ্টি করছে। সমুদ্রের তীরে তীরে, বন্দরে বন্দরে, মানুষের লোভ কদৰ্য ভঙ্গিতে স্বৰ্গকে ব্যঙ্গ করছে- এমনি করেই নিজেকে স্বৰ্গ থেকে নির্বাসিত করে দিচ্ছে । তোসামারু । পিন্যাঙ বন্দর V ২রা জ্যৈষ্ঠ। উপরে আকাশ, নীচে সমুদ্র । দিনে রাত্রে আমাদের দুই চক্ষুর বরাদ্দ এর বেশি নয়। আমাদের চোখদুটাে মা-পৃথিবীর আদর পেয়ে পেটুক হয়ে গেছে। তার পাতে নানা রকমের জোগান দেওয়া চাই । তার অধিকাংশই সে স্পর্শও করে না, ফেলা যায় । কত যে নষ্ট হচ্ছে বলা যায় না, দেখবার জিনিস অতিরিক্ত পরিমাণে পাই বলেই দেখবার জিনিস সম্পূর্ণ করে দেখি নে । এইজন্যে মাঝে মাঝে আমাদের পেটুক চোখের পক্ষে এই রকমের উপবাস ভালো । আমাদের সামনে মস্ত দুটাে ভোজের থালা, আকাশ আর সাগর । অভ্যাসদোষে প্রথমটা মনে হয়, এ দুটাে বুঝি একেবারে শূন্য থালা । তার পর দুই-এক দিন লঙ্ঘনের পর ক্ষুধা একটু বাড়লেই তখন দেখতে পাই, যা আছে তা নেহাত কম নয় । মেঘ ক্ৰমাগত নতুন নতুন রঙে সরস হয়ে আসছে, আলো ক্ষণে ক্ষণে নতুন নতুন স্বাদে আকাশকে এবং জলকে পূর্ণ করে তুলছে ! আমরা দিনরাত পৃথিবীর কোলে কঁাখে থাকি বলেই আকাশের দিকে তাকাই নে, আকাশের দিগবসনকে বলি উলঙ্গতা । যখন দীর্ঘকাল ঐ আকাশের সঙ্গে মুখোমুখি করে থাকতে হয়, তখন তার পরিচয়ের বিচিত্রতায় অবাক হয়ে থাকি । ওখানে মেঘে মেঘে রূপের এবং রঙের অহেতুক বিকাশ। এ যেন গানের আলাপের মতো, রূপ-রঙের রাগরাগিণীর আলাপ চলছে- তাল নেই, আকার-আয়তনের বাধাৰ্বিাধি নেই, কোনো অর্থবিশিষ্ট বাণী নেই, কেবলমাত্র মুক্ত সুরের লীলা । সেই সঙ্গে সমুদ্রের অন্সর নৃত্য ও মুক্ত ছন্দের নাচ । তার মৃদঙ্গ যে বোল বাজছে তার ছন্দ এমন বিপুল যে, তার লয় খুঁজে পাওয়া যায় না । তাতে নৃত্যের উল্লাস আছে, অথচ নৃত্যের নিয়ম নেই। এই বিরাট রঙ্গশালায় আকাশ এবং সমুদ্রের যে-রঙ্গ সেইটি দেখবার শক্তি ক্ৰমে আমাদের বেড়ে ওঠে। জগতে যা-কিছু মহান, তার চারি দিকে একটা বিরলতা আছে, তার পটভূমিকা (background) সাদাসিধে । সে আপনাকে দেখাবার জন্যে আর কিছুর সাহায্য নিতে চায় না । নিশীথের নক্ষত্রসভা অসীম অন্ধকারের অবকাশের মধ্যে নিজেকে প্রকাশ করে । এই সমুদ্র-আকাশের যে বৃহৎ প্রকাশ সেও বহু-উপকরণের দ্বারা আপন মর্যাদা নষ্ট করে না । এরা হল জগতের বড়ো ওস্তাদ, ছলাকলায় আমাদের মন ভোলাতে এরা অবজ্ঞা করে । মনকে শ্রদ্ধাপূর্বক আপন হতে অগ্রসর হয়ে এদের কাছে যেতে হয় । মন যখন নানা ভোগে জীৰ্ণ হয়ে অলস এবং ‘অন্যথাবৃত্তি হয়ে থাকে তখন এই ওস্তাদের আলাপ তার পক্ষে অত্যন্ত ফাকা । আমাদের সুবিধে হয়েছে, সামনে আমাদের আর কিছু নেই। অন্যবারে যখন বিলিতি যাত্রী-জাহাজে সমুদ্র পাড়ি দিয়েছি তখন যাত্রীরাই ছিল এক দৃশ্য। তারা নাচে গানে খেলায় গোলেমালে অনন্তকে আচ্ছন্ন করে রাখত। এক মুহুর্তও তারা ফাকা ফেলে রাখতে চাইত না । তার উপরে সাজসজ্জা, কায়দাকানুনের উপসর্গ ছিল । এখানে জাহাজের ডেকের সঙ্গে সমুদ্র-আকাশের কোনো প্ৰতিযোগিতা নেই। যাত্রীর সংখ্যা অতি সামান্য, আমরাই চারজন ; বাকি দু-তিনজন ধীর প্রকৃতির লোক । তার পরে, টিলাঢালা বেশেই ঘুমচ্ছি, জাগছি, খেতে যাচ্ছি, কারো কোনো আপত্তি নেই ; তার প্রধান কারণ, এমন কোনো মহিলা নেই। আমাদের অপরিচ্ছন্নতায় র্যার অসন্ত্রম হতে পারে । এইজন্যেই প্রতিদিন আমরা বুঝতে পারছি জগতে সূর্যোদয় ও সূর্যস্ত সামান্য ব্যাপার নয়, তার