পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪২২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

s Obም রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী সর্বস্ব করে চুপ করে বসে থাকতে পারে না, সে কুল খুইয়ে বেরিয়ে পড়েছে। এই বেরিয়ে যাওয়া বিপদের যাত্রা ; পথে কাটা, পথে সাপ, পথে ঝড় বৃষ্টি- সমস্তকে অতিক্রম করে, বিপদকে উপেক্ষা করে সে যে চলেছে, সে কেবল ঐ অব্যক্ত অসীমের টানে । অব্যক্তর দিকে, “আরো’র দিকে প্রকাশের এই কুল-খোওয়ানো অভিসারযাত্ৰা— প্রলয়ের ভিতর দিয়ে, বিপ্লবের কঁাটাপথে পদে পদে রক্তের চিহ্ন ঐাকে । কিন্তু কেন চলে, কোন দিকে চলে, ওদিকে তো পথের চিহ্ন নেই, কিছু তো দেখতে পাওয়া যায় না ? না, দেখা যায় না, সব অব্যক্ত কিন্তু শূন্য তো নয় ; কেননা, ঐ দিক থেকেই বাঁশির সুর আসছে। আমাদের চলা, এ চোখে দেখে চলা নয়, এ সুরের টানে চলা । যেটুকু চোখে দেখে চলি সে তো বুদ্ধিমানের চলা, তার হিসাব আছে, তার প্রমাণ আছে ; সে ঘুরে ঘুরে কুলের মধ্যেই চলা । সে চলায় কিছুই এগোয় না। আর যেটুকু বাঁশি শুনে পাগল হয়ে চলি, যে-চলায় মারা-বাচা জ্ঞান থাকে না, সেই পাগলের চলাতেই জগৎ এগিয়ে চলেছে । সেই চলাকে নিন্দার ভিতর দিয়ে, বাধান্স ভিতর দিয়ে চলতে হয় ; কোনো নজির মানতে গেলেই তাকে থমকে দাড়াতে হয় । তার এই চলার ক্লি-“দ্ধে হাজার রকম যুক্তি আছে, সে-যুক্তি তর্কের দ্বারা খণ্ডন করা যায় না। তার এই চলার কেবল একটিমাত্র কৈফিয়ত আছে- সে বলছে, ঐ অন্ধকারের ভিতর দিয়ে বাশি আমাকে ডাকছে । নইলে কেউ কি সাধ করে আপনার সীমা ডিঙিয়ে যেতে পারে । যে দিক থেকে ঐ মনোহরণ অন্ধকারের বাঁশি বাজছে ঐ দিকেই মানুষের সমস্ত আরাধনা, সমস্ত কাব্য, সমস্ত শিল্পকলা, সমস্ত বীরত্ব, সমস্ত আত্মত্যাগ মুখ ফিরিয়ে আছে ; ঐ দিকে চেয়েই মানুষ রাজ্যসুখ জলাঞ্জলি দিয়ে বিবাগি হয়ে বেরিয়ে গেছে, মরণকে মাথায় করে নিয়েছে। ঐ কালোকে দেখে মানুষ ভুলেছে। ঐ কালোর বঁাশিতেই মানুষকে উত্তরমেরু দক্ষিণমেরুতে টানে, অনুবীক্ষণ দূরবীক্ষণের রাস্তা বেয়ে মানুষের মন দুৰ্গমের পথে ঘুরে বেড়ায়, বার বার মরতে মরতে সমুদ্রপারের পথ বের করে, বার বার মরতে মরাতে আকাশপারের ডানা মেলতে থাকে । মানুষের মধ্যে যে-সব মহাজাতি কুলত্যাগিনী তারাই এগাচ্ছে, ভয়ের ভিতর থেকে অভয়ে, বিপদের ভিতর দিয়ে সম্পদে । যারা সর্বনাশা। কালোর বাশি শুনতে পেলে না তারা কেবল পুঁথির নজর জড়ো করে কুল আঁকড়ে বসে রইল, তারা কেবল শাসন মানতেই আছে। তারা কেন বৃথা এই আনন্দলোকে জন্মেছে যেখানে সীমা কাটিয়ে অসীমের সঙ্গে নীত্যলীলাই হচ্ছে জীবনযাত্ৰা, যেখানে বিধানকে ভাসিয়ে দিতে থাকাই হচ্ছে বিধি । আবার উলটো দিক থেকে দেখলে দেখতে পাই, ঐ কালো অনন্ত আসছেন তার আপনার শুভ্র জ্যোতির্ময়ী আনন্দমূর্তির দিকে । অসীমের সাধনা এই সুন্দরীর জন্যে, সেইজন্যেই তার বাশি বিরাট অন্ধকারের ভিতর দিয়ে এমন বাকুল হয়ে বাজছে ; অসীমের সাধনা এই সুন্দরীকে নূতন নূতন মালায় নতন করে সাজাচ্ছে। ঐ কালো এই রূপসীকে এক মুহুর্ত বুকের থেকে নামিয়ে রাখতে পারেন না, কেননা, এ যে তার পরমা সম্পদ । ছোটোর জন্যে বড়োর এই সাধনা যে কী অসীম, তা ফুলের পাপড়িতে পাপড়িতে, পাখির পাখায় পাখায়, মেঘের রঙে রঙে মানুষের হৃদয়ের অপরূপ লাবণো মুহুর্তে মুহুর্তে ধরা পড়ছে। রেখায় রেখায়, রঙে রঙে, রসে রসে তৃপ্তিব আর শেষ .ে.ই । এই আনন্দ কিসের - অব্যক্ত যে ব্যক্তির মধ্যে কেবলই আপনাকে প্ৰকাশ করছেন, আপনাকে ত্যাগ করে করে ফিরে পাচ্ছেন । এই অব্যক্ত কেবলই যদি না-মাত্র, শূন্যমাত্র হতেন তা হলে প্রকাশের কোনো অর্থই থাকত না, তা হলে বিজ্ঞানের অভিব্যক্তি কেবল একটা শব্দমাত্র হত । ব্যক্ত যদি অব্যক্তেরই প্ৰকাশ না হত তা হলে যা-কিছু আছে তা নিশ্চল হয়ে থাকত, কেবলই আরো-কিছুর দিকে আপনাকে নূতন করে তুলত না । এই আরো-কিছুর দিকেই সমস্ত জগতের আনন্দ কেন । এই অজানা আরো-কিছুর বঁাশি শুনেই সে কল ত্যাগ করে কেন । ঐ দিকে শূন্য নয় ব’লেই, ঐ দিকেই সে পূর্ণকে অনুভব করে ব’লেই । সেইজনাই উপনিষদ বলেছেন— ভূমৈব সুখং, ভূমাত্বে বিজিজ্ঞাসিতব্যঃ । সেইজন্যই তো সৃষ্টির এই লীলা