পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৬১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যাত্রী 886 অব্যয় পদের ছড়াছড়ি- এই জন্যে অব্যয়ের অপব্যয় সর্বদাই ঘটে । কোথাও কিছু নেই, হঠাৎ ছন্দপূরণের কাজে তাদের অস্থানে তলব পড়ে ; তাতে মাত্রা রক্ষা হয় এই মাত্র, তার বেশি কিছু না ; যেন কুলীনকন্যার কলাগাছের সঙ্গে বিবাহ দেওয়া । বর্তমান বয়সে আমার জীবনের প্রধান সংকট এই যে, যদিচ স্বভাবত আমি আরণ্যক তবু আমার কর্মস্থানের কুগ্ৰহ সকৌতুকে আমাকে সাধারণ্যক করে দাঁড় করিয়েছেন। দীর্ঘকাল আমার জীবন কেটেছে কোণে, কাব্যরচনায় ; কখন একসময় বিধাতার খেয়ালের খেয়া আমাকে পৌছে দিয়েছে জনতার ঘাটে- এখন অকাব্যসাধনে আমার দিন কাটছে । এখন আমি পাব্লিকের কর্মক্ষেত্রে । কিন্তু হাস যখন চলে। তখন তার নড়বড়ে চলন দেখেই বোঝা যায়। তার পায়ের তোলো ডাঙায় চলবার জন্যে নয়, জলে সাতার দেবার জন্যেই । তেমনি পাব্লিক ক্ষেত্রে আমার পদচারণভঙ্গি আমার অভ্যাসদোষে অথবা বিধাতার রচনাগুণে আজ পর্যন্ত বেশ সুসংগত হয় নি । এখানে কর্তৃপদে আমার যোগ্যতা নেই, যাকে অব্যয়পদ বলেছি তার কাজেও পদে পদে বিপদ ঘটে । ভলান্টিয়ারি করবার বয়স গেছে ; দুদিনের তাড়নায় চাদার খাতা নিয়ে ধনপতিদের অর্গলবদ্ধ দ্বারে অনর্গল ঘুরে বেড়াতে হয়, তাতে অঙ্কপাত যা হয় তার চেয়ে অশ্রুপাত হয় অনেক বেশি । তার পরে, গ্রন্থের ভূমিকা লেখবার জন্যে অনুরোধ আসে ; গ্ৰন্থকার অভিমতের দাবি করে. গ্রন্থ পাঠান ; কেউ বা অনাবশ্যক পত্র লেখেন, ভিতরে মাশুল দিয়ে দেন। জবাব লেখবার জন্যে আমাকে দায়ী করবার উদ্দেশ্যে ; নবপ্রসূত কুমারকুমারীদের পিতামাতারা তাদের সস্তানদের জন্যে অভূতপূর্ব নূতন নাম চেয়ে পাঠান ; সম্পাদকের তাগিদ আছে ; পরিণয়োৎসুক যুবকদের জন্যে নূতন-রচিত গান চাই ; কী উপায়ে নোবেলপ্ৰাইজ অর্জন করতে হয় সে সম্বন্ধে পরামর্শের আবেদন আসে ; দেশের হিতচেষ্টায় পত্ৰলেখকের সঙ্গে কেন আমার মতের কিছুমাত্র পার্থক্য ঘটে তার জবাবদিহির জন্যে সক্রোশ তলব পড়ে । এই সমস্ত উত্তেজনায় প্রতিনিয়ত যে-সকল কর্ম জমিয়ে তুলছি। আবর্জনামোচনে কালের সম্মার্জনী সুপটু বলেই বিধাতার কাছে সেজন্যে মার্জনা আশা করি । সভাকর্তৃত্বের কাজেও মাঝে মাঝে আমার ডাক পড়ে। যখন একান্ত কাব্যরসে নিমগ্ন ছিলুম। তখন এ বিপদ আমার ছিল না | রাখালকে কেউ ভুলেও রাজসিংহাসনে আমন্ত্রণ করে না, এইজন্যেই বটতলায় সে বঁাশি বাজাবার সময় পায় । কিন্তু, যদি দৈবাৎ কেউ ক’রে বসে, তা হলে পাচনিকে রাজদণ্ডের কাজে লাগাতে গিয়ে রাখালি এবং রাজত্ব দুয়েরই বিষ্ম ঘটে । কাব্যসরস্বতীর সেবক হয়ে গোলেমালে আজ গণপতির দরবারের তকমা পরে বসেছি ; তার ফলে কাব্যসরস্বতী আমাকে প্ৰায় জবাব দিয়েছেন, আর গণপতির বাহনটি আমার সকল কাজেরই ছিদ্র অন্বেষণ করছেন । ফরম্যাশের শরশয্যাশায়ী হবার ইচ্ছা আমার কেন নেই, সেই কথাটা এই উপলক্ষে জানালুম | যেখানে দশে মিলে কাজ সেখানে আমার অবকাশের সব গোরু বাছুর বেচে খাজনা জোগাবার তলবে কেন আমি সিভিল অথবা আনসিভিল ডিস-ওবিডিয়েন্সের নীতি অবলম্বন করতে চেষ্টা করি তার একটা কৈফিয়ত দেওয়া গেল । সব সময়ে অনুরোধ উপরোধ এড়িয়ে উঠতে পারি নি, তার কারণ আমার স্বভাব দুর্বল। পৃথিবীতে র্যারা বড়োলোক তারা রাশভারি শক্তলোক ; মহৎ সম্পদ অর্জন করবার লক্ষ্যপথে যথাযোগ্য স্থানে যথোচিত দৃঢ়তার সঙ্গে “না” বলবার ক্ষমতাই তাদের পাথেয় । মহৎ সম্পদকে রক্ষা করবার উপলক্ষে রাশভারি লোকেরা “না”-মন্ত্রের গণ্ডিটা নিজের চারি দিকে ঠিক জায়গায় মোটা করে টেনে দিতে পারেন । আমার সে মহত্ত্ব নেই, পেরে উঠি নে ; হা-না দুই নীেকার উপর পা দিয়ে দুলতে দুলতে হঠাৎ অগাধ জলের মধ্যে গিয়ে পড়ি। তাই একান্ত মনে আজ প্রার্থনা করি, “ওগো না-নীেকোর নাবিক, আমাকে জোরের সঙ্গে তোমার নীেকোয় টেনে নিয়ে একেবারে মােঝদরিয়ায় পাড়ি দাও- অকাজের ঘাটে আমার তলব আছে, দোঁটানায় পড়ে যেন বেলা বয়ে না। যায় !