পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৭৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যাত্রী 8لا ول পেল তার বাণী ; নইলে সে বোবা, নইলে সে কৃপণ, আপনি ঐশ্বৰ্য আপনি ভোগ করতে জানে না । জীব ছিল একা, বিদীর্ণ হয়ে স্ত্রী-পুরুষে সে দুই হয়ে গেল। তখনই তার সেই বিভাগের ফাকের মধ্যে বসিল তার ডাকবিভাগ । ডাকের পর ডাক, তার অন্ত নেই। বিচ্ছেদের এই ফাক একটা বড়ো সম্পদ ; এ নইলে সব চুপ, সব বন্ধ। এই ফাকটার বুকের ভিতর দিয়ে একটা অপেক্ষার ব্যথা, একটা আকাঙক্ষার টান, টনটন করে উঠল ; দিতে-চাওয়ার আর পেতে-চাওয়ার উত্তর-প্রত্যুত্তর এ-পারে ও-পারে চালাচালি হতে লাগল। এতেই দুলে উঠল সৃষ্টিতরঙ্গ, বিচলিত হল ঋতুপর্যায়, কখনো বা গ্ৰীষ্মের তপস্যা, কখনো বর্ষার প্লাবন, কখনো বা শীতের সংকোচ, কখনো বা বসন্তের দক্ষিণ্য । একে যদি মায়া বল তো দোষ নেই, কেননা, এই চিঠিলিখনের অক্ষরে আবছায়া, ভাষায় ইশারা ; এর আবির্ভাব-তিরোভাবের পুরো মানে সব সময়ে বোঝা যায় না । যাকে চোখে দেখা যায় না। সেই উত্তাপ কখন আকাশপথ থেকে মাটির আড়ালে চলে যায় ; মনে ভাবি, একেবারেই গেল বুঝি । কিছু কাল যায়, একদিন দেখি, মাটির পর্দা ফাক করে দিয়ে একটি অঙ্গুর উপরের দিকে কোন-এক আর-জন্মের চেনা-মুখ খুঁজছে। যে উত্তাপটা ফেরার হয়েছে বলে সেদিন রব উঠল। সেই তো মাটির তলার অন্ধকারে সেঁধিয়ে কোন ঘুমিয়ে-পড়া বীজের দরজায় বসে বসে ঘা দিচ্ছিল। এমনি করেই কত অদৃশ্য ইশারার উত্তাপ এক-হৃদয়ের থেকে আর-এক হৃদয়ের ফঁাকে ফঁাকে কোন চোরকোঠায় গিয়ে ঢোকে, সেখানে কার সঙ্গে কী কানাকানি করে জানি নে, তার পরে কিছুদিন বাদে একটি নবীন বাণী পর্দার বাইরে এসে বলে, “এসেছি” । আমার সহযাত্রী বন্ধু আমার ডায়ারি পড়ে বললেন, “তুমি ধরণীর চিঠি-পড়ায় আর মানুষের চিঠি-পড়ায় মিশিয়ে দিয়ে একটা যেন কী গোল পাকিয়েছ। কালিদাসের মেঘদূতে বিরহী-বিরহিণীর বেদনাটা বেশ স্পষ্ট বােঝা যাচ্ছে। তোমার এই লেখায় কোনখানে রূপক কোনখানে সাদা কথা বােঝা শক্ত হয়ে উঠেছে।” আমি বললুম, কালিদাস যে মেঘদূত কাব্য লিখেছেন সেটাও বিশ্বের কথা । নইলে তার একপ্রান্তে নির্বাসিত যক্ষ রামগিরিতে, আর-একপ্রান্তে বিরাহিণী কেন অলকাপুরীতে। স্বৰ্গমর্তের এই বিরহই তো সকল সৃষ্টিতে । এই মন্দাক্ৰাম্ভাছন্দেই তো বিশ্বের গান বেজে উঠছে। বিচ্ছেদের ফাকের ভিতর দিয়ে অণু-পরমাণু নিত্যই যে অদৃশ্য চিঠি চালাচালি করে সেই চিঠিই সৃষ্টির বাণী । স্ত্রীপুরুষের মাঝখানেও, চোখে চোখুেই হােক, কানে কানেই হােক, মনে মনেই হােক, আর কাগজে-পত্রেই হােক, যে চিঠি চলে সেও ঐ বিশ্বচিঠিরই একটি বিশেষ’ রূপ । ৫ই অক্টোবর ১৯২৪ মানুয্যের আয়ুতে ষাটের কোঠা অস্তদিগন্তের দিকে হেলে-পড়া । অর্থাৎ, উদয়ের দিগন্তটা এই সময়ে সামনে এসে পড়ে, পূর্বে পশ্চিমে মুখোমুখি হয় । জীবনের মাঝমহলে, যে কালটাকে বলে পরিণত বয়স, সেই সময়ে অনেক বড়ো বড়ো সংকল্প, অনেক কঠিন সাধনা অনেক মস্ত লাভ, অনেক মস্ত লোকসান এসে জন্মেছিল । সব জড়িয়ে ভেবেছি, এইবার আসা গেল পাকা-পরিচয়ের কিনারাটাতে । সেই সময়ে কেউ যদি হঠাৎ এসে জিজ্ঞাসা করত “তোমার বয়স কত ।” তা হলে আমার গোড়ার দিকের ছত্ৰিশটা বছর সরিয়ে রেখে বলতুম, আমি হচ্ছি। বাকিটুকু । অর্থাৎ, আমার বয়স হচ্ছে কুষ্ঠির শেষদিকের সাতাশ । এই পাকা সাতাশের রকম-সকম দেখে গভীর লোকে খুশি হল । তারা কেউ বললে “নেতা হও”, কেউ বললে “সভাপতি হও”, কেউ বললে “উপদেশ দাও।” আবার কেউ বা বললে, “দেশটাকে মাটি করতে বসেছি।” অর্থাৎ, স্বীকার । করলে দেশটাকে মাটি করে দেবার মতো অসামান্য ক্ষমতা আমার আছে । এমন সময়ে ষাটে পড়লুম। একদিন বিকেলবেলায় সামনের বাড়ির ছাতে দেখি, দশ-বারো বছরের