পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৮১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যাত্রী 8\26 একটি মাত্ৰ কথা, ফলগুলি বলছে “আমি আছি”— আর আমার মন বলে, সেইটেই আমার লাভ । আমার জীবনযাত্রার এই আড়াই বছরের ক্ষুদ্রতম সহচরীটিও মানবের বংশরক্ষার কৈফিয়ত দাখিল করেও এমন কিছু বাকি রাখে ষেটা বিশ্বের মর্মকুহর হতে উখিত ওঙ্কারধ্বনিরই সুর । বিশ্ব বলছে ওঁ ; বলছে, হঁহা ; বলছে, অয়মহং ভোঃ, এই—যে আমি । ঐ মেয়েটিও সেই ওঁ, সেই হঁহা, সেই এই-যে আমি । সত্তাকে সত্তা বলেই যেখানে মানি সেখানে তার মধ্যে আমি সেই খুশিকেই দেখি যে খুশি আমার নিজের মধ্যে চরমরূপে রয়েছে। দাসের মধ্যে সেই খুশিকে দেখি নে বলেই দাসত্ব এত ভয়ংকর মিথ্যে, আর মিথ্যে বলেই এত ভয়ংকর তার পীড়া । সৃষ্টির মূল এই লীলা, নিরস্তর এই রূপে প্ৰকাশ। সেই প্রকাশের অহৈতুক আনন্দে যখন যোগ দিতে পারি। তখন সৃষ্টির মূল আনন্দে গিয়ে মন পৌঁছয় । সেই মূল আনন্দ আপনাতেই আপনি পর্যাপ্ত, কারও কাছে তার কোনো জবাবদিহি নেই । ছোটাে ছেলে ধুলোমাটি কাটাকুটাে নিয়ে সারাবেলা বসে বসে একটা কিছু গড়ছে। বৈজ্ঞানিকের মোটা কৈফিয়ত হচ্ছে এই যে, গড়বার শক্তি তার জীবনযাত্রার সহায়, সেই শক্তির চালনা চাই । এই কৈফিয়ত স্বীকার করে নিলাম ; তবুও কথাটার মূলের দিকে অনেকখানি বাকি থাকে ! গোড়াকার কথা হচ্ছে এই যে, তার সৃষ্টিকর্তা মন বলে “হােক”, “Let there be”— সেই বাণীকে বহন করে ধুলোমাটি কুটােকাটি সকলেই বলে ওঠে, “এই দেখো হয়েছে।” এই হওয়ার অনেকখানিই আছে শিশু কল্পনায় । সামনে যখন তার একটা টিবি তখন কল্পনা বলছে, “এই তো আমার রূপকথার রাজপুত্রের কেল্লা ।” তার ঐ ধুলোর স্তুপের ইশারার ভিতর দিয়ে শিশু সেই কেল্লার সত্তা মনে স্পষ্ট অনুভব করছে ; এই অনুভূতিতেই তার আনন্দ । গড়বার শক্তিকে প্রকাশ করছি বলে আনন্দ নয়, কেননা, সে শক্তি এ ক্ষেত্রে বিশেষ প্ৰকাশ পাচ্ছে না । একটি রূপবিশেষকে চিত্তে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি বলে আনন্দ । সেই রূপটাকে শেষলক্ষ্য করে দেখাই হচ্ছে সৃষ্টিকে দেখা ; তার আনন্দই সৃষ্টির মূল আনন্দ । গান জিনিসটা নিছক সৃষ্টিলীলা । ইন্দ্ৰধনু যেমন বৃষ্টি আর রৌদ্রের জাদু, আকাশের দুটাে খামখেয়ালি মেজাজ দিয়ে গড়া তোরণ, একটি অপূর্ব মুহুর্তকাল সেই তোরণের নীচে দিয়ে জয়যাত্রা করবে। হয়ে গেল। এই খেলা, মুহূর্তটি তার রঙিন উত্তরীয় উড়িয়ে দিয়ে চলে গেল— তার বেশি আর কিছু নয় । মেজাজের এই রঙিন খেলাই হচ্ছে গীতিকাব্য । ঐ ইন্দ্ৰধনুর কবিটিকে পাকড়াও করে যদি জিজ্ঞাসা করা যেত “এটার মানে কী হল” সাফ জবাব পাওয়া যেত “কিছুই না” । “তবে ?” “আমার খুশি ।” রূপেতেই খুশি— সৃষ্টির সব প্রশ্নের এই হল শেষ উত্তর । এই খুশির খেলাঘরে রূপের খেলা দেখে আমাদের মন ছুটি পায় বস্তুর মোহ থেকে ; একেবারে পৌঁছয় আনন্দে, এমন কিছুতে যার ভার নেই, যার মাপ নেই, যা অনির্বচনীয়। দেখলুম। আমার যে পাকাবুদ্ধি সোনার খনির মুনফগ গোনে সে বোকার মতো চুপ করে রইল, আর আমার যে কাচা মনটা বললে “দেখেছি’। সে স্পষ্ট বুঝতে পারলে সোনার খনির মুনফাটাই মরীচিকা আর যার আবির্ভাবকে ক্ষণকালের জন্যে ঐ চিহ্নহীন সমুদ্রে নামহীন আকাশে দেখা গেল তারই মধ্যে চিরকালের অফুরান ঐশ্বর্য, সেই হচ্ছে অরূপের মহাপ্রাঙ্গণে রূপের নিত্যলীলা । সৃষ্টির অন্তরতম এই অহৈতুক লীলার রসটিকে যখন মন পেতে চায়। তখনই বাদশাহি বোকারের মতো সে গান লিখতে বসে । চারখানি পাপড়ি নিয়ে একটি ছোটাে জুইফুলের মতো একটুখানি গান যখন সম্পূর্ণ হয়ে ওঠে তখন সেই মহা-খেলাঘরের মেজের উপরেই তার জন্যে জায়গা করা হয় যেখানে যুগ যুগ ধরে গ্রহনক্ষত্রের খেলা হচ্ছে। সেখানে যুগ আর মুহুর্ত একই, সেখানে সূৰ্য আর সূর্যমণি ফুলে অভেদাত্মা, সেখানে সঁাঝসকালে মেঘে মেঘে যে রাগরাগিণী আমার গানের সঙ্গে তার অন্তরের মিল আছে । আজ পনেরো-ষোলো বছর ধরে কর্তব্য বুদ্ধি আমাকে নানা ভাবনা নানা ব্যস্ততার মধ্যে জোরে টেনে