পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৮৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যাত্রী 8 NշԳ আটকা পড়লে তবেই মানুষ স্পষ্ট করে আবিষ্কার করে, তার চিত্তের জন্যে এত বড়ো আকাশেরই ফাকাটা দরকার । ১ প্রবীণের কেল্লার মধ্যে আটকা পড়ে সেদিন আমি তেমনি করেই আবিষ্কার করেছিলুম, অন্তরের মধ্যে যে শিশু আছে তারই খেলার ক্ষেত্র লোকে-লোকান্তরে বিস্তৃত । এইজন্যে কল্পনায় সেই শিশুলীলার মধ্যে ডুব দিলুম, সেই শিশুলীলার তরঙ্গে সীতার কাটলুম, মনটাকে স্নিগ্ধ করবার জন্যে, নির্মল করবার জন্যে, মুক্ত করবার জন্যে । এ কথাটার এতক্ষণ ধরে আলোচনা করছি এইজন্যে যে, যে লীলালোকে জীবনযাত্রা শুরু করেছিলুম, সে লীলাক্ষেত্রে জীবনের, প্ৰথম অংশ অনেকটা কেটে গেল, সেইখানেই জীবনটার উপসংহার করবার উদবেগে কিছুকাল থেকেই মনের মধ্যে একটা মন-কেমন-করার হাওয়া বইছে। একদা পদ্মার ধারে আকাশের পারে সংসারের পথে যারা আমার সঙ্গী ছিল তারা বলছে, সেদিনকার পালা সম্পূর্ণ শেষ হয়ে যায় নি, বিদায়ের গোধূলিবেলায় সেই আরম্ভের কথাগুলো সাঙ্গ করে যেতে হবে । সেইজন্যেই সকালবেলাকার মল্লিকা সন্ধ্যাবেলাকার রজনীগন্ধা হয়ে তার গন্ধের দূত পাঠাচ্ছে। বলছে, “তোমার খ্যাতি তোমাকে না। টানুক, তোমার কীর্তি তোমাকে না বাধুক, তোমার গান তোমাকে পথের পথিক করে তোমাকে শেষ যাত্রায় রওনা করে দিক ৷ প্ৰথম বয়সের বাতায়নে বসে তুমি তোমার দূরের বঁধুর উত্তরায়ের সুগন্ধি হাওয়া পেয়েছিলে । শেষবয়সের পথে বেরিয়ে গোধূলিরাগে রাঙা আলোতে তোমার সেই দুরের বধুর সন্ধানে নিৰ্ভয়ে চলে যাও । লোকের ডাকাডাকি শুনো না । সুর যে দিক থেকে আসছে সেই দিকে কান পাতো- আর সেই দিকেই ডানা মেলে দাও সাগরপারের লীলালোকের আকাশপথে । যাবার বেলায় কবুল করে যাও যে, তুমি কোনো কাজের নও, তুমি অস্থায়ীদের দলে ।” ক্রাকোভিয়া জাহাজ ৭ই ফেব্রুয়ারি ১৯২৫ মাসোিলস বন্দরে নেমে রেলে চড়লেম । পশ্চিমাদেশের একটা পরিচয় পেলেম ভোজন-কামরায় । আকাশে গ্ৰহমালার আবর্তনের মতো থালার পর থালা ঘুরে আসছে, আর ভোজের পর ভোজ্য । ঘরের দাবি পথের উপর চলে না । ঘরে আছে সময়ের অবসর, ঘরে আছে স্থানের অবকাশ । সেখানে জীবনযাত্রার আয়োজনের ভার বেশি করে। জমে ওঠবার বাধা নেই। কিন্তু, চলতি পথে উপকরণভার যথাসম্ভব হালকা করাই সাধারণ লোকের পক্ষে সংগত । হরিণের শিঙ বটগাছের ডাল-আবডালের মতো অত অধিক, অত বড়ো, অত ভারী হলে সেটা জঙ্গম প্ৰাণীর পক্ষে বেহিসাবি হয় । "h চিরকাল, বিশেষত, পূর্বকালে, রাজা-রাজড়া আমীর-ওমরাওরা ভোগের ও ঐশ্বর্যের বোঝাকে সকল অবস্থাতেই ভরপুরভাবে টেনে বেড়িয়েছে। সংসারের উপর তাদের আবদার অত্যন্ত বেশি । সে আবদার সংসার মেনে নিয়েছে, কেননা, এদের সংখ্যা তেমন বেশি নয় । রেলগাড়ির ভোজনশালায় থালার সংখ্যা, ভোজ্যের পরিমাণ ও বৈচিত্র্য পরিচর্যার ব্যবস্থা, এত বাহুল্যময় যে, পূর্বকালের রাজকীয় সম্প্রদায়ই পথিক-অবস্থাতেও তা দাবি করতে পারত। এখন জনসাধারণের সকলের জন্যে এই VTGTer | ভোগের এত বড়ো বাহুল্যে সকল মানুষেরই অধিকার আছে, এই কথাটার আকর্ষণ অতি ভয়ানব । এই আকর্ষণে দেশজোড়া মানুষের সিধকাঠি বিশ্বভাণ্ডারের দেয়াল ফুটাে করতে উদ্যত হয় । লুব্ধ সভ্যতার এই উপদ্রব সর্বনেশে । যেটা বাহুল্য তাতে ছোটাে বড়ো কোনো মানুষের কোনো অধিকার নেই, এই কথাটা গত যুদ্ধের সময় ইংলন্ড ফ্রান্স জর্মনি প্রভৃতি যুদ্ধরত দেশকে অনেকদিন ধরেই স্বীকার করতে হল। তখন তারা