পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫০৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 br by রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯২৪ - মানুষ যে মানুষের পক্ষে কত সুদূরের জীব তা যুরোপে আমেরিকায় গেলে বুঝতে পারা যায়। সেখানকার সমাজ হচ্ছে দ্বীপশ্রেণী— ছোটাে এক এক দল জ্ঞাতির চারি দিকে বৃহৎ অজ্ঞাতির লবণসমুদ্র ; পরস্পরসংলগ্ন মহাদেশের মতো নয় । জ্ঞাতি শব্দটা তার ধাতুগত বিশেষ অর্থে আমি ব্যবহার করছি ; অর্থাৎ যে-কয়জনের মধ্যে জানাশোনা আছে, আনাগোনা চলে ; আমাদের দেশে পরস্পর আনাগোনার জন্য জানাশোনার দরকার হয় না । আমরা তো খোলা জায়গায় রাস্তার চৌমাথায় বাস করি । একে আমাদের আয়ু কম, তার উপরে অবাধ সামাজিকতায় পরস্পরের সময় নষ্ট ও কাজ নষ্ট করতে আমাদের সংকোচমাত্র নেই । আবার অন্যপক্ষে, ভোগের আদর্শ যেখানে অত্যন্ত বেশি ব্যয়সাধ্য, সুতরাং যেখানে সময়-জিনিসটাকে মানুষ টাকার দরে যাচাই করতে বাধ্য, সেখানে মানুষে মানুষে মিল কেবলই বাধাগ্রস্ত হবেই, আর সেই মিল যতই প্ৰতিহত ও অনভ্যস্ত হতে থাকবে ততই মানুষের সর্বনাশের দিন ঘনিয়ে আসবেই। একদিন দেখা যাবে, মানুষ বিস্তর জিনিস সংগ্রহ করেছে, বিস্তর বই লিখেছে, বিস্তর দেয়াল গেথে তুলেছে, কেবল নিজে গেছে হারিয়ে । মানুষ আর মানুষের কীর্তির মধ্যে সামঞ্জস্য ভেঙে গিয়েছে বলেই আজ মানুষ খুব সমারোহ করে আপনি গোরস্থান তৈরি করতে বসেছে। ২৬ সেপ্টেম্বর একজন আধুনিক জাপানি রূপদক্ষের রচিত একটি ছবি আমার কাছে আছে । সেটি যতবার দেখি আমার গভীর বিস্ময় লাগে। দিগন্তে রক্তবর্ণ সূর্য— শীতের বরফচাপা শাসন সবে-মাত্র ভেঙে গেছে, মঞ্জরীতে গাছ ভরা । সেই প্লাম গাছের তলায় একটি অন্ধ দাড়িয়ে তার আলোকপিপাসু দুই চক্ষুর সূর্যের দিকে তুলে প্রার্থনা করছে। আমাদের ঋষি প্রার্থনা করেছেন : তমসো মা জ্যোতিৰ্গময়, অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে যাও । চৈতন্যের পরিপূর্ণতাকে তারা জ্যোতি বলেছেন । তঁদের ধ্যানমস্ত্রে সূর্যকে তঁরা বলেছেন : ধিয়োয়েনঃ প্ৰচোদয়াৎ আমাদের চিত্তে তিনি ধীশক্তির ধারাগুলি প্রেরণ করছেন । ঈশোপনিষদে বলেছেন, হে পুষন, তোমার ঢাকা খুলে ফেলো, সত্যের মুখ দেখি ; আমার মধ্যে যিনি সেই পুরুষ তোমার মধ্যে । এই বাদলার অন্ধকারে, আজ আমার মধ্যে যে ছায়াচ্ছন্ন বিষাদ সে ঐ ব্যাকুলতারই একটি রূপ । সেও বলছে, হে পূষন, তোমার ঐ ঢাকা খুলে ফেলো, তোমার জ্যোতির মধ্যে আমার আত্মাকে উজ্জ্বল দেখি । অবসাদ দূর হােক । আমার চিত্তের বঁাশিতে তোমার আলোকের নিশ্বাস পূর্ণ করো— সমস্ত আকাশ আনন্দের গানে জাগ্রত হয়ে উঠুক। আমার প্রাণী-যে তোমার আলোকেরই একটি প্ৰকাশ, আমার দেহও তাই । আমার চিত্তকে তোমার জ্যোতিরঙ্গুলি যখনই স্পর্শ করে তখনই তো ভুর্ভুবঃস্বঃ দীপ্যমান হয়ে ওঠে । মেঘে মেঘে তোমার যেমন নানা রঙ আমার ভাবনায় ভাবনায় তোমার তেজ তেমনি সুখদুঃখের কত রঙ লাগিয়ে দিচ্ছে । একই জ্যোতি বাইরের পুস্পপাল্লবের বর্ণে গন্ধে এবং অস্তরের রাগে অনুরাগে বিচিত্র হয়ে ঠিকরে পড়ছে। প্ৰভাতে সন্ধ্যায় তোমার গান দিকে দিগন্তে বেজে ওঠে ; তেমনি তোমারই গান আমার কবির চিত্ত গলিয়ে দিয়ে ভাষার স্রোতে ছন্দের নাচে বয়ে চলল।