পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫২৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যাত্রী f Gł OG অথচ, মুশকিল হয়েছে এই যে, বিধাতাও আমাকে ছাড়েন নি। সৃষ্টিকর্তার লীলাঘর থেকে বিধাতার কারখানাঘর পর্যন্ত যে-রাস্তাটা গেছে সে-রাস্তার দুই প্ৰান্তেই আমার আনাগোনার কামাই নেই। এই দেটিানায় পড়ে আমি একটা কথা শিখেছি। যিনি সৃষ্টিকর্তা স এব। বিধাতা ; সেইজন্যেই তার সৃষ্টি ও বিধান এক হয়ে মিশেছে, তার লীলা ও কাজ এই দুয়ের মধ্যে একান্ত বিভাগ পাওয়া যায় না। ’ র্তার সকল কর্মই কারুকর্ম ; ছুটিতে খাটুনিতে গড়া ; কর্মের রূঢ় রূপের উপর সৌন্দর্যের আবু টেনে দিতে তার আলস্য নেই । কর্মকে তিনি লজা দেন নি । দেহের মধ্যে যন্ত্রের ব্যবস্থাকৌশল আছে কিন্তু তাকে আবৃত করে আছে তার সুষমাসৌষ্ঠব, বস্তুত সেইটেই প্ৰকাশমান । মানুষকেও তিনি সৃষ্টি করবার অধিকার দিয়েছেন ; এইটেই তার সব চেয়ে বড়ো অধিকার । মানুষ যেখানেই আপনার কর্মের গৌরব বোধ করেছে সেখানেই কর্মকে সুন্দর করবার চেষ্টা করেছে। তার ঘরকে বানাতে চায় সুন্দর করে ; তার পানিপাত্র অন্নপাত্র সুন্দর ; তার কাপড়ে—থাকে শোভার চেষ্টা । তার জীবনে প্রয়োজনের চেয়ে সজার অংশ কম থাকে না । যেখানে মানুষের মধ্যে স্বভাবের সামঞ্জস্য আছে সেখানে এইরকমই ঘটে । এই সামঞ্জস্য নষ্ট হয়, যেখানে কোনো একটা রিপু, বিশেষত লোভ অতি প্ৰবল হয়ে ওঠে । লোভ জিনিসটা মানুষের দৈন্য থেকে, তার লজ্জা নেই ; সে আপনি অসম্রামকে নিয়েই বড়াই করে । বড়ো বড়ো মুনফাওয়ালা পাটকল চটকল গঙ্গার ধারের লাবণ্যকে দালন করে ফেলেছে দম্ভভরেই। মানুষের রুচিকে সে একেবারেই স্বীকার করে নি ; একমাত্র স্বীকার করেছে তার পাওনার ফুলে-ওঠা। থলিটাকে । বর্তমান যুগের বাহ্যরূপ তাই নির্লজ্জতায় ভরা। ঠিক যেন পাকযন্ত্রটা দেহের পদ থেকে সর্বসম্মুখে বেরিয়ে এসে আপন জটিল অন্ত্রতন্ত্র নিয়ে সর্বদা দোলায়মান । তার ক্ষুধার দাবি ও সুনিপুণ পাকপ্ৰণালীর বড়াইটাই সর্বাঙ্গীণ দেহের সম্পূর্ণ সৌষ্ঠবের চেয়ে বড়ো হয়ে উঠেছে। দেহ যখন আপন স্বরূপকে প্রকাশ করতে চায় তখন সুসংযত সুষমার দ্বারাই করে ; যখন সে আপনি ক্ষুধাকেই সব ছাড়িয়ে একান্ত করে তোলে তখন বীভৎস হতে তার কিছুমাত্র লজা নেই । লালায়িত রিপুর নির্লজ্জতাই বর্বরতার প্রধান লক্ষণ, তা সে সভ্যতার গিলটি-করা তকমাই পারুক কিংবা অসভ্যতার পশুচর্মেই সেজে বেড়াক- ডেভিল ডানসই নাচুক কিংবা জজ ডানস । বর্তমান সভ্যতায় রুচির সঙ্গে কৌশলের যে বিচ্ছেদ চার দিক থেকেই দেখতে পাই তার একমাত্র কারণ, লোভটাই তার অন্য-সকল সাধনাকে ছাড়িয়ে লম্বোদর হয়ে উঠেছে । বস্তুর সংখ্যাধিক্যবিস্তারের প্রচণ্ড উন্মত্ততায় সুন্দরকে সে জায়গা ছেড়ে দিতে চায় না । সৃষ্টিপ্রেমের সঙ্গে পণ্যলোভের এই বিরোধে মানবধর্মের মধ্যে যে-আত্মবিপ্লব ঘটে তাতে দাসেরই যদি জয় হয়, পেটুকতারই যদি আধিপত্য বাড়ে, তা হলে যম। আপনি সশস্ত্ৰ দূত পাঠাতে দেরি করবে না ; দলবল নিয়ে নেমে আসবে দ্বেষ হিংসা মোহ মদ মাৎসৰ্য, লক্ষ্মীকে দেবে বিদায় করে । পূর্বেই বলেছি, দীনতা থেকে লোভের জন্ম ; সেই লোভের একটি স্থূলতনু সহােদরা আছে তার নাম জড়তা । লোভের মধ্যে অসংযত উদ্যম ; সেই উদ্যমেই তাকে অশোভন করে । জড়তায় তার উলটো, সে নড়ে বসতে পারে না ; সে না পারে সজ্জাকে গড়তে, না পারে আবর্জনাকে দূর করতে ; তার অশোভনতা নিরুদ্যমের । সেই জড়তার অশোভনতায় আমাদের দেশের মানসভ্রম নষ্ট করেছে। তাই আমাদের ব্যবহারে আমাদের জীবনের অনুষ্ঠানে সৌন্দর্য বিদায় নিতে বসল ; আমাদের ঘরে-দ্বারে বেশে-ভূষায় ব্যবহারসামগ্ৰীতে রুচির স্বাধীন প্রকাশ রইল না ; তার জায়গায় এসে পড়েছে চিত্তহীন আড়ম্বর- এতদূর পর্যন্ত শক্তির অসাড়তা এবং আপন রুচি সম্বন্ধেও নির্লজ আত্ম-অবিশ্বাস যে, আমাদের সেই আড়ম্বরের সহায় হয়েছে চৌরঙ্গির বিলিতি দোকানগুলো । বার বার মনে করি, লেখাগুলোকে করব বঙ্কিমবাবু যাকে বলেছেন “সাধের তরণী ।” কিন্তু, কোথা থেকে বোঝা এসে জমে, দেখতে দেখতে সাধের তরী হয়ে ওঠে বোঝাই-তরী। ভিতরে রয়েছে নানাপ্রকারের ক্ষোভ, লেখনীর আওয়াজ শুনেই তারা স্থানে অস্থানে বেরিয়ে পড়ে ; কোনো বিশেষ প্রসঙ্গ যার মালেক নয় এমন একটা রচনা পেলেই সেটাকে অগ্নিবাস গাড়ি করে তোলে। কেউ-বা