পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫২৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

○ つぐ。 রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী ভিতরেই ঢুকে বেঞ্চির উপর পা তুলে বসে যায়, কেউ-বা পায়দানে চড়ে চলতে থাকে ; তার পরে যেখানে-খুশি অকস্মাৎ লাফ দিয়ে নেমে পড়ে। আজ শ্রাবণমাসের পয়লা । কিন্তু বঁকড়া-বুটিওয়ালা শ্রাবণ এক ভবঘুরে বেদের মতো তার কালো মেঘের তাবু গুটিয়ে নিয়ে কোথায় যে চলে গেছে তার ঠিকানা নেই। আজ যেন আকাশসরস্বতী নীলপদ্মের দোলায় দাড়িয়ে । আমার মন ঐ সঙ্গে সঙ্গে দুলছে সমস্ত পৃথিবীটাকে ঘিরে । আমি যেন আলোতে তৈরি, বাণীতে গড়া, বিশ্বরাগিণীতে ঝংকৃত, জলে স্থলে আকাশে ছড়িয়ে যাওয়া । আমি শুনতে পাচ্ছি। সমুদ্রটা কোন কাল থেকে কেবলই ভেরী বাজাচ্ছে, আর পৃথিবীতে তারই উত্থানপতনের ছন্দে জীবের ইতিহাসযাত্রা চলেছে আবির্ভাবের অস্পষ্টতা থেকে তিরোভাবের অদৃশ্যের মধ্যে । একদল বিপুলকায় বিকটাকার প্রাণী যেন সৃষ্টিকর্তার দুঃস্বপ্নের মতো দলে দলে এল ; আবার মিলিয়ে গেল । তার পরে মানুষের ইতিহাস কবে শুরু হল প্রদোষের ক্ষীণ আলোতে, গুহাগহবর-অরণ্যের ছায়ায় ছায়ায় । দুই পায়ের উপর খাড়া-দাড়ানো ছোটাে ছোটাে চটুল জীব, লাফ দিয়ে চড়ে চড়ে বসল। মহাকায় বিপদবিভীষিকার পিঠের উপর, বিষ্ণু যেমন চড়েছেন গরুড়ের পিঠে । অসাধ্যের সাধনায় চলল তারা জীৰ্ণ যুগান্তরের ভগ্নাংশবিকীর্ণ দুৰ্গম পথে । তারই সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীকে ঘিরে ঘিরে বিরুণের মৃদঙ্গ বাজতে লাগল দিনে রাত্রে, তরঙ্গে তরঙ্গে । আজ তাই শুনছি। আর এমন-কোনো একটা কথা ছন্দে আবৃত্তি করতে ইচ্ছা করছে যা, অনাদিকালের । আজকের দিনের মতোই এইরকম আলো-ঝলমলানো কলকল্লোলিত নীলজলের দিকে তাকিয়ে ইংরেজ কবি শেলি একটি কবিতা লিখেছেন The sun is warm the sky is clear. The waves are dancing fast and bright. কিন্তু, এ তার ক্লান্ত জীবনের অবসাদের বিলাপ । এর সঙ্গে আজ ভিতরে বাইরে মিল পাচ্ছি নে । একটা জগৎজোড়া কালক্ৰন্দন শুনতে পাচ্ছি বটে, সেই ক্ৰন্দন ভরিয়ে তুলছে। অন্তরীক্ষকে, যে-আন্তরীক্ষের উপর বিশ্বরচনার ভূমিকা, যে-অন্তরীক্ষকে বৈদিক ভারত নাম দিয়েছে ক্ৰন্দসী । এ কিন্তু শ্ৰান্তিভারাতুর পরাভাবের ক্ৰন্দন নয় । এ নবজাত শিশুর ক্ৰন্দন, যে-শিশু উধৰ্ব্বস্বরে বিশ্বদ্বারে আপন অস্তিত্ব ঘোষণা করে তার প্রথমক্ৰন্দিত নিশ্বাসেই জানায়, “অয়মহং ভোঃ ।” অসীম ভাবীকালের দ্বারে সে অতিথি । অস্তিত্বের ঘোষণায় একটা বিপুল কান্না আছে । কেননা, বারে বারে তাকে ছিন্ন করতে হয় আবরণ, চূর্ণ করতে হয় বাধা । অস্তিত্বের অধিকার পড়ে-পাওয়া জিনিস নয়, প্রতি মুহুর্তেই সেটা লড়াই-করে-নেওয়া জিনিস। তাই তার কান্না এত তীব্র, আর জীবলোকে সকলের চেয়ে তীব্র মানবসত্তার নবজীবনের কান্না । সে যেন অন্ধকারের গর্ভ বিদারণকরা নবজাত আলোকের ক্ৰন্দনধ্বনি । তারই সঙ্গে সঙ্গে নব নব জন্মে নব নব যুগে দেবলোকে বাজে মঙ্গলশঙ্খ, উচ্চারিত হয় বিশ্বপিতামহের অভিনন্দনমন্ত্র । 曾 আজকের দিনে এই আমার শেষ উপলব্ধি নয় । সকালে দেখলুম, সমুদ্রের প্রান্তরেখায় আকাশ তার জ্যোতির্ময়ী চিরন্তনী বাণীটি লিখে দিলে ; সেটি পরম শান্তির বাণী, তা মর্তলোকের বহু যুগের বহু দুঃখের আর্তকোলাহলের আবর্তকে ছাড়িয়ে ওঠে, যেন অশ্রণীর ঢেউয়ের উপরে শ্বেতপদ্মের মতো । তার পরে দিনশেষের দিকে দেখলুম একটি অখ্যাত ব্যক্তিকে, যার মধ্যে মনুষ্যত্ব অপমানিত- যদি সময় পাই তার কথা পরে বলব। তখন মানব-ইতিহাসের দিগন্তে দিগন্তে দেখতে পেলুম বিরোধের কালো মেঘ, অশান্তির প্রচ্ছন্ন বজাগর্জন, আর লোকালয়ের উপর রুদ্রের ভূকুটিচ্ছায়া । ইতি ২ শ্রাবণ Soos ১ নির্মলকুমারী মহলানবিশকে লিখিত ।