পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৩২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

G 8 রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী থেকে বোঝা যায়, তখনকার ভারতবর্ষে ব্যাধ-শবরদের উপাস্য দেবতা উচ্চ শ্রেণীর হিন্দুমন্দিরে প্রবেশ করে রক্তাভিষিক্ত দেবপূজা প্রচার করেন নি । d তার পরে রামায়ণ-মহাভারতের যে-সকল পাঠ। এ দেশে প্ৰচলিত আমাদের দেশের সঙ্গে তার অনেক প্ৰভেদ । যে যে স্থানে এদের পাঠান্তর তার সমস্তই যে অশুদ্ধ, এমন কথা জোর করে বলা যায় না । এখানকার রামায়ণে রাম সীতা ভাই-বোন ; সেই ভাই-বোনে বিবাহ হয়েছিল । একজন ওলন্দাজ পণ্ডিতের সঙ্গে আমার কথা হচ্ছিল ; তিনি বললেন, তার মতে এই কাহিনীটাই প্ৰাচীন, পরবর্তীকাল এই কথাটাকে চাপা দিয়েছে । এই মতটাকে যদি সত্য বলে মেনে নেওয়া যায় তা হলে রামায়ণ-মহাভারতের মধ্যে মস্ত কয়েকটি মিল দেখতে পাই । দুটি কাহিনীরই মূলে দুটি বিবাহ । দুটি বিবাহই আর্যরীতি অনুসারে অসংগত । ভাই-বোনে বিবাহ বৌদ্ধ ইতিহাসে কোনো কোনো জায়গায় শোনা যায়, কিন্তু সেটা আমাদের সম্পূর্ণ শাস্ত্ৰবিরুদ্ধ। অন্য দিকে এক স্ত্রীকে পাচ ভাইয়ে মিলে বিবাহও তেমনি অদ্ভুত ও অশাস্ত্রীয় । দ্বিতীয় মিল হচ্ছে দুই বিবাহেরই গোড়ায় অস্ত্রপরীক্ষা, অথচ সেই পরীক্ষা বিবাহযোগ্যতা প্রসঙ্গে নিরর্থক । তৃতীয় মিল হচ্ছে, দুটি কন্যাই মানবীগর্ভজাত নয় ; সীতা পৃথিবীর কন্যা, হলরেখার মুখে কুড়িয়ে-পাওয়া ; কৃষ্ণ যজ্ঞসম্ভবা । চতুর্থ মিল হচ্ছে, উভয়ত্রই প্ৰধান নায়কদের রাজ্যচ্যুতি ও স্ত্রীকে নিয়ে বনগমন । পঞ্চম মিল হচ্ছে, দুই কাহিনীতেই শক্রর হাতে স্ত্রী অবমাননা ও সেই অবমাননার প্ৰতিশোধ । W সেইজন্যে আমি পূর্বেই অন্যত্র এই মত প্ৰকাশ করেছি যে, দুটি বিবাহই রূপকামূলক । রামায়ণের রূপকটি খুবই স্পষ্ট । কৃষির হলবিদারণরেখাকে যদি কোনো রূপ দিতেই হয় তবে তাকে পৃথিবীর কন্যা বলা যেতে পারে । শস্যকে যদি নবদুর্বদলশ্যাম রাম বলে কল্পনা করা যায়। তবে সেই শস্যও তো পৃথিবীর পুত্র । এই রূপক অনুসারে উভয় ভাইবোন, আর পরস্পর পরিণয়বন্ধনে আবদ্ধ । হরধনুভঙ্গের মধ্যেই রামায়ণের মূল অর্থ । বস্তুত সমস্তটাই হরধনুভঙ্গের ব্যাপার- সীতাকে গ্ৰহণ রক্ষণ ও উদ্ধারের জন্যে । আর্যাবর্তের পূর্ব অংশ থেকে ভারতবর্ষের দক্ষিণ প্ৰান্ত পর্যন্ত কৃষিকে বহন করে ক্ষত্রিয়দের যে-অভিযান হয়েছিল। সে সহজ হয় নি ; তার পিছনে ঘরে-বাইরে মস্ত একটা দ্বন্দ্ব ছিল । সেই ঐতিহাসিক দ্বন্দ্বের ইতিহাস রামায়ণের মধ্যে নিহিত, অরণ্যের সঙ্গে কৃষিক্ষেত্রের দ্বন্দ্ব । মহাভারতে খাণ্ডববন-দাহনের মধ্যেও এই ঐতিহাসিক দ্বন্দ্বের আভাস পাই । সেও বনের গাছপালা পোড়ানো নয়, সেদিন বন যে প্রতিকূল মানবশক্তির আশ্রয় ছিল তাকে ধবংস করা । এর বিরুদ্ধে কেবল-যে অনার্য তা নয়, ইন্দ্র র্যাদের দেবতা তারাও ছিলেন । ইন্দ্ৰ বৃষ্টিবৰ্ষণে খাণ্ডবের আগুন নেবাবার চেষ্টা করেছিলেন । মহাভারতেরও অর্থ পাওয়া যায় লক্ষ্যবোধের মধ্যে । এই শূন্যস্থিত লক্ষ্যবোধের মধ্যে এমন একটি সাধনার সংকেত আছে যে, একাগ্ৰসাধনার দ্বারা কৃষ্ণাকে পাওয়া যায় ; আর এই যজ্ঞসম্ভবা কৃষ্ণা এমন একটি তত্ত্ব যাকে নিয়ে একদিন ভারতবর্ষে বিষম দ্বন্দ্ৰ বেধে গিয়েছিল । একে একদল স্বীকার করেছিল, একদল স্বীকার করে নি। কৃষ্ণাকে পঞ্চ পাণ্ডব গ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু কৌরবেরা তাকে অপমান করতে ক্ৰটি করেন নি । এই যুদ্ধে কুরুসেনাপতি ছিলেন ব্ৰাহ্মণ দ্ৰোণাচাৰ্য, আর পাণ্ডববীর অর্জনের সারথি ছিলেন কৃষ্ণ । রামের অস্ত্রদীক্ষা যেমন বিশ্বামিত্রের কাছ থেকে, অর্জনের যুদ্ধদীক্ষা তেমনি কৃষ্ণের কাছ থেকে । বিশ্বামিত্ৰ স্বয়ং লড়াই করেন নি, কিন্তু লড়াইয়ের প্রেরণা তার কাছ থেকে ; কৃষ্ণও স্বয়ং লড়াই করেন নি। কিন্তু কুরুক্ষেত্রযুদ্ধের প্রবর্তন করেছিলেন তিনি ; ভগবদগীতাতেই এই যুদ্ধের সত্য, এই যুদ্ধের ধর্ম, ঘোষিত হয়েছে- সেই ধর্মের সঙ্গে কৃষ্ণ একাত্মক, যে-কৃষ্ণ কৃষ্ণার সখা, অপমানকালে কৃষ্ণা র্যাকে স্মরণ করেছিলেন বলে তার লজ্জা রক্ষা হয়েছিল, যে-কৃষ্ণের সম্মাননার জন্যেই পাণ্ডবদের রাজসূয় যজ্ঞ । রাম দীর্ঘকাল সীতাকে নিয়ে যে-বনে ভ্ৰমণ করেছিলেন সে ছিল অনাৰ্যদের বন, আর কৃষ্ণাকে নিয়ে পাণ্ডবেরা ফিরেছিলেন যে—বনে সে হচ্ছে ব্ৰাহ্মণ ঋষিদের বন । পাণ্ডবদের সাহচর্যে এই বনে কৃষ্ণার প্রবেশ ঘটেছিল । সেখানে কৃষ্ণা তার অক্ষয় অন্নপাত্র থেকে