পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৩৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যাত্রী Gł & \} SO কল্যাণীয়াসু মীরা, যেখানে বসে লিখছি এ একটা ডাকবাঙলা, পাহাড়ের উপরে । সকালবেলা শীতের বাতাস দিচ্ছে। আকাশে মেঘগুলো দল বেঁধে আনাগোনা করছে, সূর্যকে একবার দিচ্ছে ঢাকা, একবার দিচ্ছে খুলে । পাহাড় বললে যে-ছবি মনে জাগে এ একেবারেই সেরকম নয়। শৈলশিখরশ্রেণী কোথাও দেখা । যাচ্ছে না- বারান্দা থেকে অনতিদূরেই সামনে ঢালু উপত্যকা নেমে গিয়েছে, তলায় একটি স্বাক্ষীণ জলের ধারা একে বেঁকে চলেছে ; সামনে অন্য পারের পাডি অর্ধচন্দ্রের মতো, তার উপরে নারকেলবন আকাশের গায়ে সার বেঁধে দাড়িয়ে । উপর থেকে নীচে পর্যন্ত থাকে থাকে, শস্যের খেত । পাহাড়ের বুক বেয়ে একটা ভাঙাচোরা পথ পরপারের গ্রামের থেকে জল পর্যন্ত নেমে গেছে । জলধারার কাছেই একটা উৎস । এই উৎসকে এ দেশের লোকে পবিত্র বলে জানে ; সমস্ত দিন দেখি, মেয়েরা স্নান করে, জল তুলে নিয়ে যায় । এরা বলে, এই জলে স্নান করলে সর্ব পাপ মোচন হয় । বিশেষ বিশেষ পার্বণ আছে যখন বিস্তর লোক এখানে পুণ্যস্নান করতে আসে । এই জায়গাটার নাম ‘তীৰ্ত আম্পূল’ । তীর্ত অর্থাৎ তীর্থ, আম্পূল মানে উৎস- উৎসতীর্থ। । এই উৎস সম্বন্ধে একটি গল্প আছে । বহুকাল পূর্বে এক রাজার এক সুন্দরী মেয়ে ছিল । সেই মেয়েটি রাজার এক পারিষদকে ভালোবেসেছিল । পারিষদের মনেও যে ভালোবাসা ছিল না তা নয়, রাজকন্যার ভালোবাসা কর্তব্যবোধে প্ৰত্যাখ্যান করে । রাজকন্যা র্যাগ করে তার পানীয় দ্রব্যে বিষ মিশিয়ে দেয় । যুবক একটুখানি পান করেই ব্যাপারখানা বুঝতে পারে, কিন্তু পাছে রাজকন্যার নামে অপবাদ আসে তাই পালিয়ে এই জায়গাকার বনে এসে গোপনে মরবার জন্যে প্ৰস্তুত হয় । দেবতারা দয়া করে এই পুণ্য উৎসের জল খাইয়ে তাকে বঁচিয়ে দেন । হিন্দু ভাবের ও রীতির সঙ্গে এদের জীবন কিরকম জড়িয়ে গেছে ক্ষণে ক্ষণে তার পরিচয় পেয়ে বিস্ময় বোধ হয় । অথচ হিন্দুধর্ম এখানে কোথাও আমিশ্র ভাবে নেই ; এখানকার লোকের প্রকৃতির সঙ্গে মিলে গিয়ে সে একটা বিশেষ রূপ ধরেছে ; তার ভঙ্গিটা হিন্দু, অঙ্গটা এদের । প্রথম দিন এসেই এক জায়গায় কোন—এক রাজার অস্ত্যেষ্টিসৎকার দেখতে গিয়েছিলুম। সাজসজা-আয়োজনের উপকরণ আমাদের সঙ্গে মেলে না ; উৎসবের ভাবটা ঠিক আমাদের শ্রাদ্ধের ভাব নয় ; সমারোহের বাহ্য দৃশ্যটা ভারতবর্ষের কোনো-কিছুর অনুরূপ নয় ; তবুও এর রকমটা আমাদের মতোই ; মাচার উপরে এখানকার চুড়া-বাধা ব্ৰাহ্মণেরা ঘণ্টা নেড়ে ধূপ-ধুনো জ্বালিয়ে হাতের আঙুলে মুদ্রার ভঙ্গি করে বিড়বিড় শব্দের মন্ত্র পড়ে যাচ্ছে। আবৃত্তিতে ও অনুষ্ঠানে কিছুমাত্র স্থলন হলেই সমস্ত অশুদ্ধ ও ব্যর্থ হয়ে যায় । ব্ৰাহ্মণের গলায় পৈতে নেই । জিজ্ঞাসা করে জানা গেল, এরা ‘গায়ত্রী’ শব্দটা জানে কিন্তু মন্ত্রটা ঠিক জানে না । কেউ-বা কিছু কিছু টুকরো জানে। মনে হয়, এক সময়ে এরা সর্বাঙ্গীণ হিন্দুধর্ম । পেয়েছিল, তার দেবদেবী রীতিনীতি উৎসব-অনুষ্ঠান পুরাণম্মতি সমস্তই ছিল । তার পরে মূলের সঙ্গে যোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল, ভারতবর্ষ চলে গেল দূরে- হিন্দুর সমুদ্রযাত্রা হল নিষিদ্ধ, হিন্দু আপন গভীর মধ্যে নিজেকে কষে বাধলে, ঘরের বাইরে তার যে এক প্রশস্ত আঙিনা ছিল এ কথা সে ভুললে । কিন্তু, সমুদ্রপারের আত্মীয়-বাড়িতে তার অনেক বাণী, অনেক মূর্তি, অনেক চিহ্ন, অনেক উপকরণ পড়ে আছে বলে সেই আত্মীয় তাকে সম্পূর্ণ ভুলতে পারলে না। পথে ঘাটে পদে পদে মিলনের নানা অভিজ্ঞান চোখে পড়ে । কিন্তু সেগুলির সংস্কার হতে পায় নি বলে কালের হাতে সেই-সব অভিজ্ঞান কিছু গেছে ক্ষয়ে, কিছু বেঁকেচুরে, কিছু গেছে লুপ্ত হয়ে । - সেই-সব অভিজ্ঞানের অবিচ্ছিন্ন সংগতি আর পাওয়া যায় না । তার অর্থ কিছু গেছে ঝাপসা হয়ে, কিছু গেছে টুকরো হয়ে । তার ফল হয়েছে। এই, যেখানে-যেখানে ফাক পড়েছে সেই ফাকটা এখানকার মানুষের মন আপনি সৃষ্টি দিয়ে ভরিয়েছে। হিন্দু-ধর্মের ভাঙাচােরা কাঠামো নিয়ে এখানকার মানুষ