পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৪০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(ł RR রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী আপনার একটা ধর্ম, একটা সমাজ, গড়ে তুলেছে। এখানকার এক সময়ের শিল্পকলায় দেখা যায় পুরোপুরি হিন্দুর প্রভাব ; তার পরে দেখা যায় সে-প্রভাব ক্ষীণ ও বিচ্ছিন্ন । তবু যে-ক্ষেত্ৰকে হিন্দু উর্বর করে দিয়ে গেছে সেই ক্ষেত্রে এখানকার স্বস্থানীয় প্রতিভা প্রচুরভাবে আপনার ফসল ফলিয়েছে। এখানে একটা বহুছিদ্র পুরোনো ইতিহাসের ভূমিকা দেখি ; সেই আধ-ভোলা ইতিহাসের ছেদগুলো দিয়ে এদেশের স্বকীয় চিত্ত নিজেকে প্ৰকাশ করছে । বালিতে সব-প্ৰথমে কারেম-আসন বলে একজায়গার রাজবাড়িতে আমার থাকবার কথা । সেখানকার রাজা ছিলেন বাংলির শ্রাদ্ধ-উৎসবে । পারিষদসহ বালির ওলন্দাজ গবর্নর সেখানে মধ্যাহ্নভোজন করলেন, সেই ভোজে আমরাও ছিলেম । ভোজ শেষ করে যখন উঠলেম তখন বেলা তিনটে । সকালে সাড়ে ছটার সময় জাহাজ থেকে নেমেছি ; ঘাটের থেকে মোটরে আড়াই ঘণ্টা বঁ্যাকানি ও ধুলো খেয়ে যজ্ঞস্থলে আগমন । এখানে ঘোরাঘুরি দেখাশুনা সেরে বিনা মানেই অত্যন্ত ক্লান্ত ও ধূলিস্নান অবস্থায় নিতান্ত বিতৃষ্ণার সঙ্গে খেতে বসেছি ; দীর্ঘকালপ্রসারিত সেই ভোজে আহার ও আলাপ-আপ্যায়ন সেরে আমাদের নিমন্ত্রণকর্তা রাজার সঙ্গে তার মোটরগাড়িতে চড়ে আবার সুদীর্ঘ পথ ভেঙে চললুম তার প্রাসাদে । প্রাসাদকে এরা পুরী বলে । রাজার ভাষা আমি জানি নে, আমার ভাষা রাজা বোঝেন না- বোঝবার লোকও কেউ সঙ্গে নেই । চুপ করে গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে রইলুম । মস্ত সুবিধে এই, এখানকার প্রকৃতি বালিনি ভাষায় কথা কয় না ; সেই শ্যামার দিকে চেয়ে চেয়ে দেখি আর অরসিক মোটরগাড়িটাকে মনে মনে অভিশাপ দিই। মনে পড়ল, কখনো কখনো শুষ্কচিত্ত গাইয়ের মুখে গান শুনেছি ; রাগিণীর যেটা বিশেষ দরদের জায়গা, যেখানে মন প্ৰত্যাশা করছে, গাইয়ের কণ্ঠ অত্যুচ্চ আকাশের চিলের মতো পাখাটা ছড়িয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ স্থির থাকবে কিংবা দুই-একটা মাত্র মীড়ের ঝাপটা দেবে, গানের সেই মর্মস্থানের উপর দিয়ে যখন সেই সংগীতের পালোয়ান তার তানগুলোকে লোটন-পায়রার মতো পালটিয়ে পালটিয়ে উড়িয়ে চলেছে, তখন কিরকম বিরক্ত হয়েছি। পথের দুই ধারে গিরি অরণ্য সমুদ্র, আর সুন্দর সব ছায়াবেষ্টিত লোকালয়, কিন্তু কিছুমাত্র দরদ নেই ; মনটা ক্ষণে ক্ষণে বলে উঠছে, “আরে, রোসো রোসো, দেখে নিই।” কিন্তু, এই কল-দৈত্য মনটাকে ছিনিয়ে নিয়ে চলে যায় ; তার একমাত্র ধুয়ো, “সময় নেই, সময় নেই।” এক জায়গায় যেখানে বনের ফাকের ভিতর দিয়ে নীল সমুদ্র দেখা গেল রাজা আমাদের ভাষাতেই বলে উঠলেন “সমুদ্র” ; আমাকে বিস্মিত ও আনন্দিত হতে দেখে আউড়ে গেলেন, “সমুদ্র, সাগর, অব্ধি, জলাঢ্য ।” তার পরে বললেন, “সপ্তসমুদ্র, সপ্তপর্বত, সপ্তবন, সপ্তআকাশ ।” তার পরে পর্বতের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, “আদ্রি” ; তার পরে বলে গেলেন, “সুমেরু, হিমালয়, বিন্ধ্য, মলয়, ঋষ্যমূক ৷” এক জায়গায় পাহাড়ের তলায় ছোটাে নদী বয়ে যাচ্ছিল, রাজা আউড়িয়ে গেলেন, “গঙ্গা, যমুনা, নর্মদা, গোদাবরী, কাবেরী, সরস্বতী ।” আমাদের ইতিহাসে একদিন ভারতবর্ষ আপন ভৌগোলিক সত্তাকে বিশেষভাবে উপলব্ধি করেছিল ; তখন সে আপনার নদীপৰ্বতের ধ্যানের দ্বারা আপন ভূমূর্তিকে মনের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করে নিয়েছিল । তার তীর্থগুলি এমন করে বাধা হয়েছে- দক্ষিণে কন্যাকুমারী, উত্তরে মানসসরোবর, পশ্চিমসমুদ্র তীরে দ্বারকা, পূর্ব সমুদ্রে গঙ্গাসংগম- যাতে করে তীর্থভ্রমণের দ্বারা ভারতবর্ষের সম্পূর্ণ রূপটিকে ভক্তির সঙ্গে মনের মধ্যে গভীরভাবে গ্রহণ করা যেতে পারে। ভারতবর্ষকে চেনবার এমন উপায় আর কিছু হতে পারে না । তখন পায়ে হেঁটে ভ্ৰমণ করতে হত সুতরাং তীর্থভ্রমণের দ্বারা কেবল যে ভারতবর্ষের ভূগোল জানা যেত তা নয়, তার নানাজাতীয় অধিবাসীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয় আপনিই হত ; সেদিন ভারতবর্ষের আত্মোপলব্ধি একটা সত্যসাধনা ছিল বলেই তার আত্মপরিচয়ের পদ্ধতিও আপনিই এমন সত্য হয়ে উঠেছিল । যথার্থ শ্রদ্ধা কখনো ফাকি দিয়ে কাজ। সারাতে চায় না । অর্থাৎ রাষ্ট্রসভার রঙ্গমঞ্চের উপর ক্ষণিক মিলনের অভিনয়কেই সে মিলন বলে নিজেকে ভোলাতে চায় না । সেদিন মিলনের সাধনা ছিল অকৃত্রিম নিষ্ঠার সাধনা |