পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৫০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

G \OS রবীন্দ্র-রচনাবলী বেশে ভূষায়, উৎসবে অনুষ্ঠানে, সব প্রথমেই যেটা খুব করে মনে আসে সেটা হচ্ছে সমস্ত জাতটার মনে শিল্পরচনায় স্বাভাবিক উদ্যম । একজন পাশ্চাত্য আর্টিস্ট এখানে তিন বৎসর আছেন ; তিনি বলেন, এদের শিল্পকলা থেমে নেই, সে আপন বেগে আপন পথ করে নিয়ে এগিয়ে চলেছে, কিন্তু শিল্পী স্বয়ং সে-সম্বন্ধে আত্মবিস্মৃত । তিনি বলেন, কিছুকাল পূর্বে পর্যন্ত এখানে চীনেদের প্রভাব ছিল, দেখতে দেখতে সেটা আপনি ক্ষয়ে আসছে, বালির চিত্ত আপন ভাষাতেই আত্মপ্ৰকাশ করতে বসেছে । তার কাজে এমন অনায়াস প্রতিভা আছে যে, আধুনিক যে দুই-একটি মূর্তি তিনি দেখেছেন সেগুলি যুরোপের শিল্পপ্রদর্শনীতে পাঠালে সেখানকার লোক, চমকে উঠবে এই তার বিশ্বাস । এই তো গেল রূপ-উদ্ভাবন করবার এদের স্বাভাবিক শক্তি । তার পরে, এই শক্তিটিই এদের সমাজকে মূর্তি দিচ্ছে। এরা উৎসবে অনুষ্ঠানে নানা প্ৰণালীতে সেই রূপ সৃষ্টি করবার ইচ্ছাকেই সুন্দর করে প্রকাশ করতে প্ৰবৃত্ত । যেখানে এই সৃষ্টির উদ্যম নিয়ত সচেষ্ট সেখানে সমস্ত দেশের মুখে একটি শ্ৰী ও আনন্দ ব্যক্তি হয় । অথচ, জীবনযাত্রার সকল অংশই যে শোভন তা বলা যায় না । এর মধ্যে অনেক জিনিস আছে যা আনন্দকে মারে, অন্ধ সংস্কারের কত কদাচার, কত নিষ্ঠুরতা । যে-মেয়ে বন্ধ্যা প্রেতলোকে গলায় দড়ি বেঁধে তাকে অফলা গাছের ডালে চিরদিনের মতো বুলিয়ে রাখা হয়, এখানকার লোকের এই বিশ্বাস । কোনো মেয়ে যদি যমজ সন্তান প্রসব করে, এক পুত্র, এক কন্যা, তা হলে প্রসবের পরেই বিছানা নিজে বহন করে সে শ্মশানে যায় ; পরিবারের লোক যমজ সন্তান তার পিছন-পিছন বহন করে নিয়ে চলে । সেখানে ডালপালা দিয়ে কোনোরকম করে একটা কুঁড়ে বেঁধে তিন চান্দ্ৰমাস তাকে কাটাতে হয় । দুই মাস ধরে গ্রামের মন্দিরের দ্বার রুদ্ধ হয়, পাপক্ষালনের উদ্দেশে নানাবিধ পূজাৰ্চনা চলে। প্রসূতিকে মাঝে মাঝে কেবল খাবার পাঠানো হয়, সেই কয়দিন আর সঙ্গে সকলরকম ব্যবহার বন্ধ । এই সুন্দর দ্বীপের চিরবসন্ত ও নিত্য উৎসবের ভিতরে ভিতরে অন্ধ বুদ্ধির মায়া সহস্ৰ বিভীষিকার সৃষ্টি করেছে, যেমন সে ভারতবর্ষেও ঘরে ঘরে করে থাকে । এর ভয় ও নিষ্ঠুরতা থেকে যে-মোহমুক্ত জ্ঞানের দ্বারা মানুষকে বাচায় যেখানে তার চর্চা নেই, তার প্রতি বিশ্বাস নেই, সেখানে মানুষের আত্মবিমাননা আত্মপীড়ন থেকে তাকে কে বাচাবে । তবুও এইগুলোকেই প্রধান করে দেখবার নয়। জ্যোতির্বিদের কাছে সূর্যের কলঙ্ক ঢাকা পড়ে না, তবু সাধারণ লোকের কাছে তার আলোটাই যথেষ্ট । সূর্যকে কলঙ্কা বললে মিথ্যা বলা হয় না, তবুও সূর্যকে জ্যোতির্ময় বললেই সত্য বলা হয় । তথ্যের ফর্দ লম্বা করা যে-সব বৈজ্ঞানিকের কাজ তারা পশুসংসারে হিংস্র দাতনখের ভীষণতার উপর কলমের ঝোক দেবামাত্র কল্পনায় মনে হয়, পশুদের জীবনযাত্রা কেবল ভয়েরই বাহন । কিন্তু, এই-সব অত্যাচারের চেয়ে বড়ো হচ্ছে সেই প্ৰাণ যা আপনার সদাসক্রিয় উদ্যমে আপনাতেই আনন্দিত, এমন-কি, শ্বাপদের হাত থেকে আত্মরক্ষার কৌশল ও চেষ্টা সেও এই আনন্দিত প্ৰাণক্রিয়ারই অংশ । ইন্টার-ওসেন নামক যে মাসিকপত্রে একজন লেখকের বর্ণনা থেকে বালির মেয়েদের দুঃখের বৃত্তান্ত পাওয়া গেল, সেই কাগজেই আর-একজন লেখক সেখানকার শিল্পকুশল উৎসববিলাসী সৌন্দর্যপ্ৰিয়তাকে আনন্দের সঙ্গে দেখেছেন । তার সেই দেখার আলোতে বোঝা যায়, গ্রানির কলঙ্কটা অসত্য না হলেও সত্যও নয়। এই দ্বীপে আমরা অনেক ঘুরেছি ; গ্রামে পথে বাজারে শস্যক্ষেত্রে মন্দিরদ্ধারে উৎসবভূমিতে ঝরনাতলায় বালির মেয়েদের অনেক দেখেছি ; সব জায়গাতেই তাদের দেখলুম সুস্থ, সুপরিপুষ্ট, সুবিনীত, সুপ্ৰসন্ন— তাদের মধ্যে পীড়া অপমান অত্যাচারের কোনো চেহারা তো দেখলুম না । খুঁটিয়ে খবর নিলে নিশ্চয় কলঙ্কের কথা অনেক পাওয়া যাবে ; কিন্তু খুঁটিয়ে-পাওয়া ময়লা কথাগুলো সূতো দিয়ে এক সঙ্গে গাথলেই সত্যকে স্পষ্ট করা হবে, এ কথা বিশ্বাস করবার নয় । देख्ठि s3 CSS S sqq সুরাবায়া। জাভা।” ১ অমিয়চন্দ্ৰ চক্রবর্তীকে লিখিত ।