পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৫১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যাত্রী (\OV) ܘ সুরকর্তা । জাভা কল্যাণীয়াসু বেীমা, বালি থেকে পার হয়ে জাভা দ্বীপে সুরবায়া শহরে এসে নামা গেল। এই জায়গাটা হচ্ছে বিদেশী সওদাগরদের প্রধান আখড়া । জাভার সব চেয়ে বড়ো উৎপন্ন জিনিস চিনি, এই ছোটাে দ্বীপটি থেকে দেশবিদেশে চালান যাচ্ছে। এমন এক কাল ছিল, পৃথিবীতে চিনি বিতরণের ভার ছিল ভারতবর্ষের । আজ এই জাভার হাট থেকে চিনি কিনে বৌবাজারের ভীমচন্দ্ৰ নাগের সন্দেশ তৈরি হয়। ধরণী, স্বভাবত কী দান করেন আজকাল তারই উপরে ভরসা রাখতে গেলে ঠকতে হয়, মানুষ কী আদায় ক’রে নিতে পারে। এইটেই হল আসল কথা । গোরু আপনা-আপনি যে-দুধর্টুকু দেয় তাতে কেঁড়ে শূন্য হয়ে যায়। যারা ওস্তাদ গোয়ালা তারা জানে কিরকম খোরাকি ও প্ৰজননবিধির দ্বারা গোরুর দুধ বাড়ানো চলে। এই শ্যামল দ্বীপটি ওলন্দাজদের পক্ষে ধরণী-কামধেনুর দুধভরা বাটের মতো । তারা জানে, কোন প্ৰণালীতে এই বাট কোনোদিন একফোটা শুকিয়ে না যায়, নিয়ত দুধে ভরে থাকে ; সম্পূর্ণ দুইয়ে-নেবার কৌশলটাও তাদের আয়ত্ত । আমাদের কর্তৃপক্ষও তাদের গোয়ালবাড়ি ভারতবর্ষে বসিয়েছেন, চা আর পাট নিয়ে এতকাল তাদের হাট গুলজার হল ; কিন্তু, এদিকে আমাদের চাষের খেত নিজীব হয়ে এসেছে, সঙ্গে সঙ্গে জিব বেরিয়ে পড়ল। চাষিদের । এতকাল পরে আজ হঠাৎ তাদের নজর পড়েছে আমাদের ফসলহীন দুর্ভাগ্যের প্রতি । কমিশন বসেছে, তার রিপোর্টও বেরোবে । দরিদ্রের চাকাভাঙা মনোরথ রিপোটের টানে নড়ে উঠবে কি না জানি নে, কিন্তু রাস্তা বানাবার কাজে যে-সব রাজমজুর লাগবে মজুরি মিলতে তাদের অসুবিধে হবে না । মোট কথা, ওলন্দাজরা এখানে কৃষিক্ষেত্রে খুব ওস্তাদি দেখিয়েছে ; তাতে এখানকার লোকের অন্নের সংস্থান হয়েছে, কর্তৃপক্ষেরও ব্যাবসা চলছে ভালো । এর মধ্যে তত্ত্বটা হচ্ছে এই যে, দেশের প্রতি প্ৰেম জানাবার জন্যে দেশের জিনিস ব্যবহার করব, এটা ভালো কথা ; কিন্তু দেশের প্রতি প্ৰেম জানাবার জন্যে দেশের জিনিস-উৎপাদনের শক্তি বাড়াতে হবে, এটা হল-পাকা কথা । এইখানে বিদ্যার দরকার ; সেই বিদ্যা বিদেশ থেকে এলেও তাকে গ্ৰহণ করলে আমাদের জাত যাবে না, পরন্তু জানা রক্ষা হবে । সুরবায়াতে তিন দিন আমরা র্যার বাড়িতে অতিথি ছিলেম। তিনি সুরকর্তার রাজবংশের একজন প্রধান ব্যক্তি, কিন্তু তিনি আপন অধিকার ইচ্ছাপূর্বক পরিত্যাগ করে এই শহরে এসে বাণিজ্য করছেন । চিনি রপ্তানির কারবার ; তাতে তার প্রভূত মুনাফা। চমৎকার মানুষটি, প্রাচীন অভিজাতকুলযোগ্য মর্যাদা ও সৌজন্যের অবতার। তার ছেলে আধুনিক কালের শিক্ষা পেয়েছেন ; বিনীত, নম্ৰ, প্রিয়দর্শন- তারই উপরে আমাদের অতিথিপরিচর্যার ভার । বড়ো ভয় ছিল, পাছে অবিশ্রাম অভ্যর্থনার পীড়নে আরাম-অবকাশ সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু, সেই অত্যাচার থেকে রক্ষা পেয়েছিলেম। তাদের প্রাসাদের এক অংশ সম্পূর্ণ আমাদের ব্যবহারের জন্যে ছেড়ে দিয়েছিলেন । নিরালায় ছিলেম, ত্রুটিবিহীন আতিথ্যের পনেরো-আনা অংশ ছিল নেপথ্যে । কেবল আহারের সময়েই আমাদের পরস্পর দেখাসাক্ষাৎ । মনে হত, আমিই গৃহকর্তা, তারা উপলক্ষ মাত্র । সমাদরের অন্যান্য । আয়োজনের মধ্যে সকলের চেয়ে বড়ো জিনিস ছিল স্বাধীনতা ও অবকাশ । এখানে একটি কলাসভা আছে। সেটা মুখ্যত য়ুরোপীয় । এখানকার সওদাগরদের ক্লাবের মতো । কলকাতায় যেমন সংগীতসভা এও তেমনি । কলকাতার সভায় সংগীতের অধিকার যতখানি এখানে কলাবিদ্যার অধিকার তার চেয়ে বেশি নয় । এইখানে আর্ট সম্বন্ধে কিছু বলবার জন্যে আমার প্রতি অনুরোধ ছিল ; যথাসাধ্য বুঝিয়ে বলেছি। একদিন আমাদের গৃহকর্তার বাড়িতে অনেকগুলি এদেশীয় প্রধান ব্যক্তির সমাগম হয়েছিল । সেদিন সন্ধ্যাবেলায় তাদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়া ছিল আমার কাজ । সুনীতিও একদিন তাদের সভায় বক্তৃতা করে এসেছেন ; সকলের ভালো লেগেছে।